p20170502-1247202

শীতলক্ষ্ম্যা নদী মরে গেলেও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে নদীর বুকে জেগে আছে সেই প্রাচীনতম ভাসমান ডকইয়ার্ডটি। এই ভাসমান ডকইয়ার্ডটি নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলার চৌরাপাড়ায় বিআইডব্লিউটিসির নৌযান মেরামতের ইর্মাজেন্সি বিভাগ হিসেবে পরিচিত ফ্লোটিং ডকইয়ার্ড।

আমি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি এই বিআইডব্লিউটিসির নৌযান মেরামত করার ডকইয়ার্ডটিকে। এই ডকইয়ার্ডের পাশেই ছিল আমাদের বসবাস, সাবেক আদর্শ কটন মিলস্, বর্তমান শোহাগপুর টেক্সটাইল মিলস্। স্কুলে যাবার আগে বন্ধুদের সাথে শীতলক্ষ্ম্যায় ঝাঁপ দিয়ে ভাসতে ভাসতে আসতাম এই ডকইয়ার্ডে। এসেই সবাই মিলে শুরু করে দিতাম লাফা-লাফি আর ডকের ভেতরে দৌড়াদৌড়ি।

p20170502-1247032

এসব করার সময় ডকইয়ার্ডে কর্মরত কর্মচারীদের বকুনিও খেয়েছি অনেক। আবার কোনোকোনো দিন বিকালবেলা মাছ ধরার বরশী নিয়ে চলে আসতাম ডকইয়ার্ডে মাছধরার জন্য। এই ডকইয়ার্ডটির চারপাশ ছিল মাছের অভয়ারণ্য। বাংলাদেশের ছয়-ঋতুর প্রায় সব ঋতুতেই এর চারদিক মাছে ভরপুর থাকতো। বরশী ফেলার সাথে সাথেই পাওয়া যেত নানারকম মাছ। বর্তমানে শীতলক্ষ্ম্যার পাড়ে বহুরকম ড্রাইং কারখানা গড়ে উঠেছে। সেসব ডাইং কারখানার নির্গত কেমিক্যালের পানি শীতলক্ষ্যায় মিশ্রিত হয়ে পুরো নদীর পানি এখন বিষাক্ত হয়ে গেছে। যার কারণে আর ডকইয়ার্ডের আশে-পাশে আগের মতো মাছ থাকেনা। যাক সেসব কথা না-হয় আরেকদিন বেলবো, এখন ডকইয়ার্ডটি ইতিহাস নিয়ে  বিস্তারিত কিছু জানাতে চাই।

p20170502-194447_1

জানা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান আলফেজ উইলিয়ামস এন্ড ডোভস লিমিটেড ১৯৪৫ সালে এটি নির্মাণ করে। জাহাজের ত্রুটিপূর্ণ তলদেশ মেরামত এবং দ্রুত বিকল ইঞ্জিনের ত্রুটি সারানোর কাজে এই ফ্লোটিং ডকইয়ার্ডের জুড়ি নেই। এ ডকইয়ার্ডে ৫ টি পন্টুন আছে। পন্টুনগুলোর অভ্যন্তরে বৈদ্যুতিক মটর পাম্পের সাহায্যে ডকইয়ার্ডটির ভেতরে পানি ঢুকিয়ে সম্পূর্ণ ডকইয়ার্ডটি ডুবিয়ে দেয়া হয়। তখন ডকিংয়ে ত্রুটি সারতে আসা জাহাজটিকে আরেকটি ছোট ইঞ্জিনচালিত জাহাজে ঠেলে ইয়ার্ডের ভিতরে নিয়ে যায়। তখন ত্রুটিপূর্ণ জাহাজটিকে বসানোর জন্য থাকা সমান উচ্চতায় থরে থরে সাজানো কাঠের বড় বড় স্তম্ভের উপর বসিয়ে দেয়া হয়। এরপর পাম্পের সাহায্যে পন্টুনের পানি আবার সেচতে শুরু করে দেয় ডকইয়ার্ডে এই কাজে নিয়োজিত থাকা কর্মচারীরা। পুরো ডকে পানি ঢুকিয়ে ডকইয়ার্ডটি ডুবাতে যতক্ষণ সময় লেগেছিল, তার চাইতে অধিক সময় ব্যয় করে জাহাজসহ নিমজ্জিত ডকইয়ার্ডটি জাগিয়ে তোলা হয় আস্তে-ধীরে।

auto20170502-072305_1_1_1

এরপর শুরু হয় ত্রুটিপূর্ণ জাহাজটির সংস্কার কাজ। একেকটা জাহাজ মেরামত করতে অনেকদিন সময় লেগে যায়। কোনোকোনো জাহাজ মাস খানেক যাবত এই ডকইয়ার্ডে থাকতে হয়। সম্পূর্ণ মেরামতের পর জাহাজটি নামাতে একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। যখন বছরের শেষ ডিসেম্বর মাসের আগমন ঘটে তখন নদীতে এমনিতেই পানি কমে যায়। সেসময় ডকইয়ার্ডটি ডুবাতে আর জাগাতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ডকইয়ার্ডে দায়িত্বে থাকা কর্মচারীদের। কারণ, এই ডকইয়ার্ডটি চৌরাপাড়া গুদারাঘাট সংলগ্ন নদীর পাড় ঘেঁষে। সেই কারণে বর্ষা মৌসুম ছাড়া সেখানে পানি থাকে খুব কম। ডকইয়ার্ড ডুবাতে জাগাতে তা মাটিতে ঠেকে যায়। তখন সবার অপেক্ষা করতে হয় জোয়ারের জন্য। নদীতে জোয়ার না-হওয়া পর্যন্ত আর মেরামত হওয়া জাহাজটিকে ডেলিভারি দিতে পারেনা ডক কর্মচারীরা। যখন জোয়ার আসে তখন আবার শুরু হয় ডকইয়ার্ড ডুবানো জাগানোর পালা। এভাবেই চলছে এর কাজ, আর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ভাসমান ডকইয়ার্ডটি ভেসে আছে শীতলক্ষ্ম্যা নদীর পচা পানির উপর।

0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ