নিউইয়র্ক সিটির স্কুলগুলোয় প্যারেন্ট-টিচার কনফারেন্স হয় বছরে চারবার। সন্তানের অগ্রগতির ব্যপারে আলোচনার জন্যে শিক্ষকদের সাথে বাবা-মা'র বৈঠক এটি। যেহেতু এখানে আমাদের দেশের মত রোল নং ১,২,৩... দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মেধার মূল্যায়ন করা হয় না, বিধায় প্রতিবার বৈঠকেই ক্লাসে অন্যদের চেয়ে আমার সন্তানদের তুলনামূলক অবস্থান জানার জন্য আমাকে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হয়। যেমন, সে যদি অংকে ৯৫ পায়, আমি শ্রেণি শিক্ষককে জিজ্ঞেস করি, "তোমার ক্লাসে ৯৫ এর উপরে নাম্বার কি কেউ পেয়েছে ? কতজন পেয়েছে ? কোন বিষয়ের শিক্ষক বলেন, আমার ক্লাসে সে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। কোন বিষয়ের শিক্ষক বলে, আমার ক্লাসে সে তৃতীয়, চতুর্থ অবস্থানে আছে। এমন করে আমি একটি ধারনা নেই। এখানে স্কুলগুলো প্রতিটি শিক্ষার্থীর প্রাইভেসি মেইনটেইন করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একজনের ফলাফল অন্যজন জানতেও পারেনা। কেননা এতে শিশুরা হিংসাত্মক হয়ে উঠে। কখনোবা হীনমন্যতায় ভোগে।  

খুব ছোটবেলা থেকেই তাঁদের নানান টপিকের উপর লিখতে দেয়া হয়।তার আগে ধারনা দেয়া হয় লেখাটির শুরু কেমন করে হবে, মাঝের প্যারা কেমন হবে, আর উপসংহার কেমন হবে। যেমন, একদিন বাচ্চাদের দলবেঁধে স্টেডিয়ামে নিয়ে যায়, খেলা দেখায়, এবং খেলা সম্পর্কে লিখতে পরদিন সকলকে হোমওয়ার্ক দিয়ে দেয়।আবার, কখনো চিড়িয়াখানায় ট্রিপে নিয়ে যায়, ঘণ্টা খানেক ঘুরিয়ে দেখায়, এবং তা সম্পর্কে লিখতে পরদিন হোমওয়ার্ক দেয়। অতঃপর প্রত্যেকে নিজের মত করে লিখে। যাঁদের লেখা সবদিক থেকে ভাল হয়, সেগুলো নোটিশ বোর্ডে লাগিয়ে দেয়া হয় অন্যদের দেখবার, জানবার, শিখবার সুবিধার্থে। কোন শিক্ষক আবার সর্বোচ্চ নাম্বার পাওয়া লেখাগুলো কপি করে অন্য ছাত্রছাত্রীদের বিলি করেন নিজ দায়িত্বে। এভাবে প্রায় সকলেই এগিয়ে যায়। একের সাথে অন্যের ফলাফলের পার্থক্য খুব বেশি হয় না। আর যারা আশানুরূপ ফলাফলে ব্যর্থ হয়, তাঁদের জন্যে সামার ক্লাস থাকে। অর্থাৎ গ্রীষ্মের দুই মাস বন্ধের সময়টাতে মানোন্নয়নমূলক কর্মসূচি এটি। এছাড়াও পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্যে আফটার স্কুল কর্মসূচি থাকে। স্পেশাল ক্লাস থাকে। অর্থাৎ তাঁদেরও এগিয়ে নেবার জন্যে প্রচেষ্টার কমতি থাকে না। 

আমাদের দেশের স্কুলগুলোতে যাদের রোল নং প্রথম দিকে, তাঁরা কখনো পিছিয়ে থাকাদের সাথে বন্ধুত্ব করে না। কথা বলতে চায় না। একরকম অহংকার নিয়ে দাপটের সাথে থাকতে পছন্দ করে। এমন কি শিক্ষকরাও অন্যদের সামনে পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের তাচ্ছিল্য করতে ছাড়ে না। অধিকাংশ ভাল ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের লেখা কিংবা নোট অন্যদের দেখতে দিতে চায় না। আমার এখনো মনে আছে, কিভাবে লিখলে ভাল নাম্বার পাওয়া যায় সেটি জানবার জন্যে, শুধু একটু ধারনা নেবার জন্যে, পাশে বসা ভালো ছাত্রীটির নোট দেখতে অগোচরে ঘাড় বেঁকিয়ে চেষ্টা করতে হতো। একদিকে শিক্ষকদের তাচ্ছিল্য, অন্যদিকে বাড়িতে বাবা-মা'র "অমুক পারলে তুই পারবি না কেন" টাইপের কথা __ কি নির্দয় মানসিক চাপ ! 

আমার এক বন্ধুর মেয়ে জিপিএ ফাইভ পায়নি বলে ভয়ে বাবার কাছ থেকে একরকম পালিয়ে পালিয়ে থাকছে। তাই এ লেখার অবতারনা।

একজন মা কোথাও একাকি বেড়াতে গেলে, কেউ ভাল কিছু খেতে দিলে শুধুই সন্তানদের কথা মনে পড়ে। মনে হয়, ইস্‌ আমার সন্তান এই খাবারটা পেলে কতোই না খুশি হতো। আমার অবস্থা হয়েছে অনেকটা এমন। বিদেশে ভাল কিছু দেখলে শুধুই মনে হয়, ইস্‌, আমার দেশেও যদি এমন হতো !     

সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা...

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 Shares

৮টি মন্তব্য

  • মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)

    বিদেশের লেখা পড়া পদ্ধতি আর আমাদের পদ্ধতির মাঝে বিরাট তফাৎ যা আপনার লেখাই বলে দেয়।আসলে আমাদের দেশের লেখা পড়ার পদ্ধতি যা আছে তাতে বেশীর ভাগ ছেলে মেয়ের জীবনে তেমন একটা কাজে আসে না কেবল মাত্র ডাঃ ইঞ্জিঃ ছাড়া আর সব জ্ঞানের ভান্ডার ইতিহাসবিদ হন।এখানে কারিগরি শিক্ষার প্রতি নজর কোন কালে কোন মন্ত্রনালয়েরই ছিল না অথচ বিদেশে যে স্কুল বা কলেজেই পড়ুক সে জব নিয়ে শিক্ষা শেষ করেন।ধন্যবাদ।

  • নীলাঞ্জনা নীলা

    রিমি আপু সত্যি এখানকার পড়ালেখা অসাধারণ! আমি তো দেখছি শুধু কানাডাতে নয়, তীর্থ জাপান-বেলজিয়ামের স্কুলেও গিয়েছিলো। প্রতিটি দেশেই এই একইরকম শিক্ষাব্যবস্থা। তীর্থ ২০০৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০০৯ সালের আগষ্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের স্কুলেও পড়েছিলো। আমার নিজেরই কান্না পেতো। ওর স্কুলের ব্যাগের ওজন, তারপর বাসায় ফিরেই টিফিন শেষ করেই হোম ওয়ার্ক শুরু। সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোর কথা ভাবতেই চাইনা।

    জানো সেদিন তীর্থ এসে বললো, “মাম একটা কথা বলবে? এশিয়ান বাবা-মায়েরা কেন A+ না পেলে রাগ করে?” আমি বললাম আমি কি রাগ করি? বলে “না তুমি করোনা। কিন্তু আমি যদি কখনো A+ না পাই, তুমি কি রাগ করবে?” বললাম না করবো না। তুই কি B পেয়েছিস? বললো, ওর বন্ধু পেয়েছে। ওর মা ওকে বকেছে-মেরেছেও। রিমি আপু আসলে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থাতেও অনেকেই সন্তুষ্ট না। এমনকি তাদের মানসিকতারও বদল হয়নি।

    ভালো রেখো। তুমি কি আজকাল খুব বেশী ব্যস্ত?

    Happy New Year 2017 -{@

  • জিসান শা ইকরাম

    আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পাল্টাবে কি? মনে হয় না।
    শিক্ষকদের ধারনাই নেই কিভাবে ছাত্রদের পড়াতে হবে,
    পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের জন্য কিভাবে শিক্ষাদান করতে হবে, এ বিষয়ে কিন্তু আমাদের দেশে একটি প্রকল্প আছে,
    প্রকল্প থাকলে কি হবে? প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা চলে যায় সেমিনার, গাড়ি, বিভিন্ন দ্রব্যাদি ক্রয়ের বিল ভাউচারে।
    শিক্ষকরা ভাল ছাত্রদের দিকেই নজর দেন, খারাপদের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখান।

    নববর্ষের শুভেচ্ছা -{@

  • মৌনতা রিতু

    এই আমি ও এই যাঁতাকলে পিষ্ট। আমার দুই ছেলেও পেসটিজের কারনে নিজেরাই পড়ে, কারন, ক্লাস ম্যাডামই ভাল করে কথা বলে না একটু কম মার্ক পেলে। গার্জিয়ান ডেকে পাঠায়। এরপর আছে ভর্তি যুদ্ধ। এই বিষয়ে অনেক লিখেছি কোনো কিছুতেই কিছু হবে না। তাই স্পিক্টি নট হয়েছি।

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ