images
আমি যখন প্রথম কাজে যোগদান করি তখন বাংলাদেশ টেকনোলজিতে এতোটা অগ্রসরমান ছিলো না। এখন যেমন সবার ঘরেঘরে কম্পিউটার, হাতেহাতে ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, তখন বরং কম্পিউটারটাই ছিলো এক রহস্যঘেরা জাদুর বাক্স!

আমার কাজে যোগদানের মাত্র কিছুদিন আগে অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম স্যার এ প্রতিষ্ঠানে একটু সিনিয়র লেবেলে যোগদান করেছিলেন। আমার প্রথম কম্পিউটারে হাতেখড়ি মুলতঃ এই স্যারের কাজ করতে গিয়েই। বর্তমানের মতো সেসময় প্রত্যেকের টেবিলে টেবিলে কম্পিউটার ছিলো না। আমার নিজের ডিপার্টমেন্ট এবং অন্য একটা ডিপার্টমেন্ট মিলে বরাদ্দ ছিলো একটা কম্পিউটার, আর সারা অফিসে ছিলো হাতেগোনা চারটা। এখনতো বাসাবাড়িতেও কম্পিউটার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে, তখন তেমনটা ছিলোনা। হয়তো সব অফিসেও তখন ছিলোনা।

যোগদানের কিছুদিন পরই ডিপার্টমেন্টের জন্য আলাদা কম্পিউটার বরাদ্দ হয়। আর আমিতো বরাবরই এই যন্ত্রটার ব্যাপারে একটু বেশিই কিউরিয়াস ছিলাম। এতোদিন কেবল গল্পই শুনে এসেছি, এবার হয়তো হাতে ধরে দেখতে পারবো, সে সুযোগ এসেছে। অন্যরকম একটা চার্মিং ভাব! আত্মীয়স্বজন দু-চারজনের যে ছিলোনা, তা নয়। কিন্তু কেবলই শুনতাম ধরলেই নাকি ভাইরাস আক্রমন করবে। তাই ভয়ে ধারে-কাছেও যেতাম না।

যাহোক, ডিপার্টমেন্টে আমি একেবারেই নতুন। সবার কাছ থেকে চেয়েবুঝে কাজ জেনে নিতে হচ্ছে, করতে হচ্ছে। কেউ তো আর হাতে ধরে শিখাবে না। এর থেকে চেয়ে এটা, ওর থেকে জেনে ওটা করছি, শিখছি কিন্তু নজরটা পড়ে থাকতো সবসময় সে বাক্সটার দিকেই। কি জাদুই না বাক্সের ভেতরে লুকিয়ে আছে! কিন্তু কোন উছিলাই পেতাম না ওটার সামনে বসার। কলিগরা বসে কাজ করলে মনযোগ থাকতো তাঁদের দিকে। ডিপার্টমেন্টে একমাত্র জহির স্যারই ছিলেন বয়সে প্রবীন। প্রাইভেট কোম্পানী, সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত, হাফিয়ে উঠা অবস্থা। কাজের ধারা অনুযায়ী কম্পিউটারে ডাটা তৈরীতে প্রবীণ জহির স্যার খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না আবার কেউ তাঁকে সহযোগীতা করবে সে সুযোগও কেউ পাচ্ছেনা। এমনি এক পরিস্থিতিতে জহির স্যারের নির্দেশনায় কম্পিউটারে ডাটা তৈরীতে হেল্পিং হ্যান্ড হিসাবে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হলো। হায় আল্লাহ! রহস্যঘেরা জাদুর বাক্স আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে কিন্তু আমিতো কিচ্ছু জানিনা! বলা হলো শুরু করো, আস্তে আস্তে হয়ে যাবে। অন্য কলিগরাও বলছিলো, আমরা দেখিয়ে দেবো। নিঃসন্দেহে কলিগরা খুব ভালো ছিলো। ভীরুমনে প্রথম যেদিন কম্পিউটারের মাউসে হাত রাখলাম, ওমা! একি কাণ্ড! কাজ করবো কি!! এতো দেখি এদিকে ধরলে ওদিকে দৌড়ায়!!! মাউসের রহস্য উন্মোচনে বলা যায় টানা দুইঘন্টা লেগেছিলো আমার মাউসকে কনট্রল করতে। যাহোক মাস দুয়েকের মধ্যেই আমি সকলের সাহায্য নিয়ে জহির স্যারের সব রেজিস্টারগুলো কম্পিউটারে সেট করে নিলাম। বলা যায়, তাঁর কাজের বহর সামলানোই আমাকে অল্পদিনে পারদর্শীতা অর্জনে সাহায্য করেছিলো। এরপর প্রয়োজনের তাগিদে একটা সময় সবার টেবিলে কম্পিউটার সেট হয়ে যাওয়ায় জহির স্যারও আমাদের সাহায্যে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন কিন্তু বাধ সাধলো তাঁর বয়স! একসময় নির্ধারিত বয়স অতিক্রম করায় তাঁকে বিদায় নিতে হলো।

আর এখন? জন্ম নিয়ে মানবশিশু হাঁটতে শেখার সাথেসাথেই টেকনোলজির সাথেও পরিচিত হয়ে উঠছে। ডেক্সটপের জায়গায় ল্যাপটপ, ট্যাবলেট এসেছে। মাউসের বদলে টাচিং সিস্টেমে আঙ্গুলের ছোঁয়াতেই সব হয়ে যাচ্ছে।

গুগল থেকেঃ
witch-computer-restoration-uk-story-top

কে তৈরি করল এই জাদুর বাক্সটা?
এ প্রশ্নের উত্তরে সবার আগে চলে আসে চালর্স ব্যাবেজর নাম। মূলত তিনিই আধুনিক কম্পিউটারের জনক। কিন্তু কম্পিউটারের ইতিহাস প্রায় পাঁচ হাজার বছরে পুরোনো! সে সময় গ্রিক সভ্যতায় এবাক্যাস নামে এক ধরনের গণনা যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তীকালে চীনসহ পৃথিবীর বহুদেশেই এব্যাক্যাস ব্যবহৃত হতো। তারপর কেটে যায় বহু বহু বছর।

১৮৩৬ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী চার্লস ব্যাবেজ তৈরি করেন এনালাইটিক ইঞ্জিন নামে উন্নত মানের এক সংয়ক্রিয় গণকযন্ত্র। এটি নিজেই তথ্য সংগ্রহ করতে পারতো। দুই অংশে বিভক্ত ছিল যন্ত্রটা। মেমরি ও ভিজিট। মেমরিতে ধরে রাখা ৫০ থেকে ১০০০টি সংখ্যা পর্যন্ত পরে আবার কাজে লাগানো যেত।

তবে আজকাল যে মডেলের কম্পিউটার প্রচলিত এ ধরনের কম্পিউটার প্রথম তৈরি করেছিল আমেরিকার পেনিনসোলা বিশ্ববিদ্যালয়। এর নাম রাখা হয় এনিয়াক (ENIAC- Electronic Numorical Integrator and Computer)
এই কম্পিউটারে ওজন প্রায় ত্রিশ টন এবং ঘণ্টায় ১৫৬ কিলোওয়ার্ড বিদ্যুৎ ব্যয় হতো। এরপর ১৯৪৯ সালে জনফন নমম্যানের দেওয়া নতুন এক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হলো অ্যাডভ্যাক কম্পিউটার।

১৯৪৭ সালে আমেরিকার বেল ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন ট্রানজিস্টর নামের এক ক্ষুদ্র ইলেক্টনিক্স পার্টস। কম্পিউটারে ইলেক্ট্রিক ভাল্বের পরিবর্তে ব্যবহার শুরু হলো ট্রানজিস্টরের। আমূলে বদলে গেল কম্পিউটারের চেহারা।
শুরু হলো দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারের যুগ। তবে এ যুগও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আইসি আবিষ্কারের পর ১৯৫৯ সালে কম্পিউটারে সংযোজিত হলো নতুন এই ইলেক্টনিক্স পার্টস। তৈরি হলো মিনি কম্পিউটার। মিনি কম্পিউটার দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারের তুলনায় অনেক বেশি কার্যক্ষম।

১৯৭০ সাল থেকে মাইক্রো কম্পিউটার যুগের শুরু। সেদিনের কম্পিউটারের সাথে আজকের অত্যাধুনিক কম্পিউটারের পার্থক্য ও কার্যক্ষমতা আকাশ আর পাতাল। প্রতিদিন বিশ্বের নানা প্রান্তে আবিষ্কৃত হচ্ছে কম্পিউটারের নতুন প্রযুক্তি আর নতুন নতুন মডেল ও সুবিধা সম্পন্ন কম্পিউটার।

***আমাদের চোখের সামনে এখন পুরো বিশ্ব। টেকনোলজি পৃথিবীটাকে আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিযেছে কিন্তু অজান্তেই কেড়ে নিচ্ছে মানবিক বোধগুলোক। ক্রমেই আমরা যন্ত্রের সাথে চলতে চলতে কেমন যেনো যান্ত্রিক হয়ে উঠছি। তাই মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞানকে অভিশাপ নয়, আর্শীবাদ হিসাবে গ্রহণ করেই মানবিকতা, মননশীলতা, সৃজনশীলতাকে জাগ্রত রেখে সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে।

0 Shares

২৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ