olyahme_65354

লিখাটা গতকালই লিখেছিলাম কিন্তু পোস্ট করা সম্ভব হয়নি।
আমার বর্তমান সময়ের ১০-৬টা অফিসটাইম ছাড়া দিনের বাকী সময়টুকু কাটে আম্মাকে ঘিরেই। আম্মা অসুস্থ, শয্যাশায়ী। এখন সে সন্তানদের কাউকে না কাউকে পাশে চায়। বাসায় থাকাকালীন আমার প্রতিটা মুহুর্তই এখন তাঁর জন্য বরাদ্দ। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে, শরীরে তেল ম্যাসেজ করে দিলে, শরীর-হাত-পা টিপে দিলে, চুল আচড়িয়ে দিলে আমি অনুভব করি সে ভীষণ শান্তি পায। হ্যাঁ, তাঁর জন্য নিয়োগকৃত পরিচর্যাকারী মেয়েটাও তাঁকে এই সেবাগুলো যথেষ্টই দেয়, তবে তা আমার অনুপস্থিতিকালে। আমি যতোক্ষণ বাসায় থাকি ততোক্ষণ এই কাজগুলোতে সে যেমন আমাকে আশা করে, আমার মাধ্যমে হলে আনন্দ পায়; তেমনি আমিও অন্যরকমের এক তৃপ্তি অনুভব করি। নিজের হাতে ঔষধ খাইয়ে দেয়া, ভাত খাইয়ে দেয়া, রাতে ঘুমানোর আগে দাঁত ব্রাশ করিয়ে, মাউথওয়াস দিয়ে কুলকুচি করিয়ে তারপর নেবুলাইজার দেয়া, ধরে ধরে ওয়াসরুমে নিয়ে যাওয়া। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া এগুলো এখন আমার নিত্যদিনের কাজ। একাজগুলো আমার মনে মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। এর মধ্য দিয়েই আমি একটু একটু করে দেখতে পাই ’মা’ কি করে আস্তে আস্তে হাঁটার শিশু থেকে প্রথম হাঁটতে পারা, তারপর আস্তে আস্তে কোলের শিশু থেকে বিছানার শিশু হয়ে যাচ্ছেন। গতদিন অফিসের জন্য বের হওয়ার সময় তাঁকে বলতে গিয়েছি, আমাকে বলে “যাও, আমার জন্য কি আনবে?” জিজ্ঞেস করলাম, ”কি আনবো?” বলে, ”আচার আর কাঁচা আম।” সিরোসিসের প্যাশেন্টদের বমেটিং ভাব একটু বেশি কাজ করে। আরেকদিন তেমন করে নাস্তা খাওয়ানোর সময় বলেছিলো, ”আগে চিপস এনে দাও।” আজকে নাস্তা খাইয়েছি ফ্রিজে সংরক্ষনে থাকা কাঁচা আম বের করে রসুন-ধনেপাতা দিয়ে ভর্তা বানিয়ে তা খাওযার লোভ দেখিয়ে।

অইদিন আমাকে বলছিলো, তোমরা কেউ একজন কাছে থাকলে আমার মনে হয় আমার সব আছে। কথাটা শুনে আমার বড়বেশি অসহায়বোধ জেগেছিলো মনে। জীবনের প্রয়োজনে আমরা সন্তানেরা বৃদ্ধ মা-বাবাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারি না। আমার মায়ের পাঁচ সন্তানের পাঁচজনই তাঁর জন্য নিবেদিতপ্রাণ। দিনে আমি অফিস করি বলে অই সময়টা মেজোবোনের তত্বাবধানে থাকেন। কর্মব্যস্ততার ফাঁকে দুপুরের গোসল করানো এবং খাওয়ানো সে নিজহাতেই করে। ছোটবোনটা এসে মাঝেমাঝে কিছুদিন করে থেকে যায়। আর ভাই তো এসময়টাতে প্রতি বৃহশপতিবারেই অফিস করে সরাসরি চলে আসে। মা’য়ের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান সে। সে আসবে শুনলেই মা অপেক্ষায় থাকেন, তাঁর মধ্যে এক ধরনের পুলকিতভাব জাগে। ছোটভাইটা দেশের বাইরে থাকলেও স্কাইপে মা-ছেলের সংযোগ প্রায় প্রতিদিনই ঘটে। এর মধ্যে আবার আম্মা’র সবসময় চেন্সও ভালো থাকে না। শরীরের বিভিন্ন অরগানগুলো এখন ঘনঘন ডির্স্টাব করে। বেশিরভাগ সময় যন্ত্রণাকাতর থাকেন।

আমার মাঝেমধ্যে মনে হয় আমরা সন্তানরা বড়বেশি স্বার্থপর। একটা মা, তাঁর বাচ্চার প্রয়োজনে কতোটা স্যাক্রিফাইস করে! অথচ অই এক(!) মায়ের জন্য আমরা পাঁচ পাঁচটা সন্তান সেরকম কিছু করতে পারছি না। বাস্তবতার প্রয়োজনে আমাদের দৌড়াতেই হয়।

সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গাড়ীতে উঠেই নেট অন করেছি কিছু লিখবো বলে। প্রসঙ্গ মা এবং ব্লগে সরব উপস্থিতি কমে যাওয়া। লিখা অসম্পূর্ণ, তাই পোস্ট না দিয়েই অফিস শুরু করি। এরই মধ্যে দুপুরে জানতে পেলাম, যে ডাক্তারের তত্বাবধানে আমার মা গত দেড়/দুই বছর যাবত ভালো আছেন, সে ডাক্তারই নাকি গত দুদিন আগে স্ট্রোক করে পিজিতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।

’এক সেকেন্ডের নাই ভরসা’ গানটি শেষ হওয়ার সাথে সাথে মৃত্যূর কোলে ঢলে পড়া ফিরোজ সাঁই’র সেই গানটি এই মুহুর্তে খুব মনে পড়ছে।

ডাঃ গোলাম মোস্তফা, সহযোগী অধ্যাপক, লিভার, গেস্ট্রো ও মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

অসম্ভব ভালো একজন ডাক্তার, রোগীর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। কোন পেশাদারী মনোভাব নয়, রোগীকে সেবা দেয়াই মূখ্য। লিভারের প্যাশেন্ট আমার মা’কে কিভাবে পরিচর্যার মাধ্যমে দীর্ঘদিন ভালো রাখা যায়, পর্যাপ্ত সময় নিয়ে তিনি কলাকৌশল বলে দিতেন। যে কারনে আম্মাকে নিয়ে ঘনঘন ডাক্তারের চেম্বারে দৌড়াতে হতো না। অনেক তো দেখলাম, আজকালকার পেশাদার ডাক্তারদের। এমনটা তো কেউ করেনই না বরং চেম্বার থেকে রোগী বের হবার আগেই পরবর্তী রোগীকে ডাকতে কলিংবেল চেপে বসেন। এই ডাক্তারের তত্বাবধানেই আজ মা’কে ভর্তি করিয়ে ব্লাড আর এলবুমিন দেয়ার কথা ছিলো। যোগাযোগ করতেই খবরটা জানতে পারলাম। বিস্তারিত আর কিছু জানা সম্ভব হয়নি। পরিপূর্ণ সুস্থ-সবল, শক্ত গোছের একজন মানুষ তিনি। দোয়া করি তিনি দ্রুত সেরে উঠুন। আর আরো কিছু অসুস্থ মানুষ এরকম একজন নিবেদিতপ্রাণ ডাক্তারের সেবা পাবার সুযোগ পাক।

আজ ১৬ই মার্চ। ঠিক একমাস আগে গত ১৫ই ফেব্রুয়ারী নির্ধারিত হাসপাতালে সীট না পাওয়ায় ডাঃ গোলাম মোস্তফার রেফার করা অন্য এক হাসপাতালে মা’কে ইমারজেন্সীতে নিয়ে গেলে ডাক্তার প্রয়োজনীয় চেক আপ শেষে বলে বসলো প্যাশেন্টের অবস্থা ক্রিটিক্যাল, আপনারা আত্মীয়স্বজনকে খবর দেন, দেখে যাক। দীর্ঘ রোগে ভোগা মা’কে নিয়ে আমাদের মানসিক প্রস্তুতি থাকলেও কথাটা শুনে মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়েছিলো। আল্লাহর অশেষ কৃপায় পরেরদিন থেকে মা ধীরে ধীরে রেসপন্স করতে শুরু করেন।

আজ একমাস হলো। আম্মা এই ভালো তো এই খারাপ মিলিয়ে মোটামুটি আছেন।

জন্মিলে মৃত্যু অবধারিত জেনেও আমরা প্রিয়জনদের হারাতে চাই না। ভালো মানুষগুলো হারিয়ে গেলে কষ্ট পাই। আমার মা’র অবস্থা টালমাটাল, তাই প্রার্থনা করি যতোদিন বেঁচে থাকেন যেনো সুস্থভাবে বাঁচেন। আর রোগীর প্রতি সহানুভূতিশীল সেই ডাক্তার গোলাম মোস্তফা, তিনি শক্ত গোছের মানুষ; বেঁচে ফিরলে অনেক মানুষ তাঁর সেবা পাবে, সুন্দরভাবে বাঁচবে। কামনা করি তিনি সুস্থভাবে ফিরে আসুন।

দু’জনের জন্যই সকলের কাছে দোয়াপ্রার্থী।

বিঃদ্রঃ অনেকদিন যাবত সোনেলা'য় লিখালিখির মাধ্যমে সহব্লগারদের সাথে যোগাযোগ নেই, তাই আজকের এই পোস্ট।
আর পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলা, মায়ের প্রতি সন্তানের দায়বদ্ধতা অনেক কিন্তু আমরা কতটুকুনই বা তা করতে পারি! পাঠকদের তা ভেবে দেখা উচিৎ।

0 Shares

২৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ