তার সাথে আমার আলাপ হয় ফেইসবুক থেকে। আলাপের সুত্রটা ছিলো একটু অন্যরকম। কোন এক সময় সে আমার ফ্রেন্ডলিস্টে চলে আসে। ইনবক্সে প্রথম দু-এক কথার পর অকারন প্যাঁচাল পারা দেখে আমি আর রেসপন্স করছিলাম না। সে অবশ্য সমীহ নিয়েই কথা বলছিলো। একসময় বিরক্তি প্রকাশ করে সে আমাকে 'ফেক আইডি' ইউজ করি মন্তব্য করায় আমি রাগত ভাষায় তাকে নীচের কথাগুলো বলি :

"হাউ ডেয়ার ইউ!
তোমার সাহস তো কম নয় ছেলে! আমি কি করবো না করবো তা নিয়ে তোমার এতো মাথাব্যথা কেনো? লজ্জা তো আমি তোমাকে ফেবুলিস্টে এড করে এখন পাচ্ছি, এ কেমন ছেলেকে আমি ফ্রেন্ডলিস্টে নিলাম!
আমি এখন তোমাকে ব্লক করার সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছি, এখন তুমিই বলো কি করবো? আমি নিজে থেকে কাউকে ব্লক করতে চাইনা, কিন্তু বিরক্তিকর কোন কাজও সহ্য করতে পারিনা।
তোমরা বাচ্চা বাচ্চা ছেলে হয়ে কি করে এভাবে কথা বলো?
শুন ছেলে, কথা বলার মতো অরকম সময় আমার নেই, হয়ে উঠেনা। তাই জরুরী প্রয়োজন ছাড়া ইনবক্স এড়িয়ে চলি। ভালো ছেলে হয়ে থাকতে চাইলে থাকো নইলে তুমি চলে যেতে পারো, তোমার ইচ্ছা।
কখনো সময় পেলে আমি নিজে থেকেই কথা বলে নেবো।
যাক, ভালো থেকো। খোদাহাফেজ।"

এভাবে কথা বলার দুদিন পর নিজেরই একটু খারাপ লাগতেছিলো, বাচ্চা ছেলে এভাবে বকা দিলাম। কোন এক শুক্রবারে ফ্রি হয়ে ভাবলাম একটু কথা বলি। বলতে গিয়ে দেখি, কি অবাক কান্ড ছেলেটি ফ্রেন্ডলিস্ট থেকেই চলে গেছে!
খারাপ লাগতেছিলো, মনে হচ্ছিলো এভাবে বলা হয়তো ঠিক হয়নি। জিজ্ঞেস করি....
--কি ব্যাপার ছেলে! তুমি চলে গিয়েছো যে! এতোটুকু বকাও সইতে পারলে না? তোমরা বাচ্চাবাচ্চা ছেলেরা ঠিকমতো কথাবার্তা না বললে তো বকা দিবোই, সত্যি সত্যি তো আর চলে যেতে বলিনি।
--আপনাকে খুব ভয় পেয়েছি, তাই.....মনে করেছিলাম আপনি ম্যাডামের মতো। আসলে এখন মনে হচ্ছে আপনি মা'য়ের মতো। এতো মায়া-মমতা আপনার, তবুও বকা দেন কেন?

ব্যস! এর পর থেকে ছেলেটির সাথে আমার মাঝেমধ্যেই কথা হতো, সে তার বাবার জীবনের করুন পরিনতির কথা, নিজের জীবন নিয়ে ভাবনার কথা, ক্ষোভের কথা ইত্যাদি শেয়ার করতো।
জিজ্ঞেস করি কি হয়েছিলো বাবার? আমাকে বলে.
--এটা অনকে লঙ স্টোরি। চিনা প্রবাদ আছে "টাকা যখন কথা বলে, সত্য তখন চুপ করে থাকে" আমাদের কষ্টের দিনগুলো অবশ্যই শেষ হবে। হয়তো সেদিন বেশি দুরে নয় যেদিন আমি তাদের শাসন করবো যারা অসহায় মানুষদের জুলুম করে। আমি আমাদের এলাকার মানুষদের কাছে খুব পপুলার। অনার্স কম্পলিট করে BCS ট্রাই করবো, যদি চান্স না পাই তাহলে ব্ল্যাকমেইলার হবো; দ্যাটস অল।

আমি অবাক হই তার এসব কথা শুনে, বুঝিয়ে বলি ভুল পথ কখনো শান্তি নিয়ে আসেনা। তোমার মতো মেধাবী ছেলে ভাবনাতে এমন নেগেটিভ চিন্তা কাজ করবে কেনো? তাকে বলি..
-- তোমার কথাগুলো অনেক মনযোগ দিয়ে পড়লাম। উপলব্দি করছি মানবতার প্রতি তোমার অনেক গভীর অনুভুতি আছে, প্রেম আছে কিন্তু আবার বাবার বিড়ম্বনা তোমার বুকে অনেক কষ্ট ও প্রতিহিংসার জন্ম দিয়েছে।
তোমার লক্ষ্য অনেক আশাব্যঞ্জক কিন্তু যদির পরে যে ইচ্ছা ব্যক্ত করেছো আমি এর তীব্র বিরোধিতা করছি।
ভেবে দেখো তুমি ৪ ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। পরিবারে যে বড়, তার দায়িত্ব অনেক। তোমার ছোটরা তোমাকে অনুসরণ করবে। এদিকে তোমার বাবা দেশে নেই, তিনি ইচ্ছের বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়েছেন। ওখানে পরিবারের আপনজনদের থেকে দুরে থেকে নিশ্চয় কষ্ট করে রোজগার করে টাকা পাঠান যাতে তাঁর সন্তানরা বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হয়, যা দেখে তাঁর বুক গরবে ভরে উঠবে।
কাজেই আমি তোমাকে পরামর্শ দেবো সবশেষ কথাটি (black meailar) মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও আর বাদবাকি যে চিন্তাধারা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছো সেভাবেই সামনে এগোতে থাকো। মনে রাখবে 'সততাই সর্বোত্তম পন্থা'। অবশ্যই কষ্টের দিন শেষ হবে। আলো একদিন আসবেই! যদি সে আলো সুন্দর পথে আসে তোমার মনও আলোকিত থাকবে। দুনিয়াজোড়াও সে আলো ছড়িয়ে পড়বে।
এরপর একদিন সে আমাকে বলে বসে
--কেমন আছো মামনি? (3
--ভালো। তুমি কেমন আছো? জিজ্ঞেস করি, মামনি বললে যে!
--ভাল আছি! আমি হসপিটালে। তাই!!! তুমিতো সত্যিই মায়ের মতো! (3

আরও যেনো দুর্বলতা গ্রাস করে আমাকে। একদিন সে জানায়, কলেজের ম্যাগাজিনে সে একটি কবিতা লিখেছে। কবিতাটি আমাকে ইনবক্সে ইংরেজী বর্ণমালায় লিখে পড়তে দেয়।

''কাঙ্ক্ষিত রাজনীতি"
এসো সব স্লোগান, সব মিছিল এক হয়ে যাই
এসো বিপ্লব ঘটাই মিলন প্রত্যাশায়
শোধন করি কষ্টেসৃষ্টে সৃষ্ট হওয়া স্বপ্ন
দৃশ্যমান হোক আজীবন লালিত পিপাসা,
যা শুকনো মরুর তপ্ত বালুকারাশির মতো উত্তপ্ত!
শান্তির পারাবার দর্শনে যাই এসো
অঞ্জলি ভরে পান করে হই তৃপ্ত
সোনার বাঙলার প্রয়োজনে এসো সবাই সোনার মানুষ হয়ে যাই
যদি সব প্রাণ আত্মা এক হয়ে যাই
একই শিবিরে মুক্তি আকাঙ্ক্ষায়
পালাবে 'লক্ষন'
কেঁপে উঠবে রাবনের আসন।

এরপর আরেকদিন তার একটি স্ট্যাটাস দেখে আমি রাগ হয়ে তাকে বলি..
-- খামোকাই আমি ছেলেসম ভাবনা নিয়ে তোমাকে স্নেহ-ভালোবাসা দিয়েছি। মানুষকে ঠকিয়ে যে সুখী হওয়ার চিন্তা করে, আত্মসুখ খুঁজে বেড়ায় তার সাথে আমার আর কোন কথা হতে পারেনা। তোমার মননে সারাক্ষন খেলা করে ব্ল্যাক মেইলিং এর চিন্তা, মানুষ ঠকানোর চিন্তা।
কোথায় চিন্তা করবে কি করে সমাজের এই নষ্ট মানুষগুলোকে নিশ্চিহ্ন করা যায়, তা না উল্টা দেশের প্রতি প্রতিশোধপ্রবণতা দেখিয়ে যাচ্ছো!
আমার সংস্পর্শ তোমার মধ্যে একটুও পরিবর্তন আনতে পারেনি ভেবে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।

-- যে দেশ, প্রশাসন, আর মানুষের প্রতি এতো ঘৃণা বুকের ভেতর জমা থাকে সেই দেশে ভাল মানুষ হওয়ার চিন্তা করতে খুব কষ্ট হয়।শুধু প্রশাসন নয় মানুষ গুলো তার চেয়েও বেশি খারাপ! তাই নিজের প্রতি চরম ঘৃণা হয় যখন ভাবি দেশ প্রেমিক হবো, মানুষের উপকার করবো!!!
কষ্ট, ক্ষোভ, অভিমান চেপে রাখতে না পেরে প্রকাশ করলাম! আপনি এতো রাগ করবেন,এতো কষ্ট পাবেন জানলে প্রকাশও করতাম না!!!

-- কষ্ট আমি পেয়েছি তুমি সেই এক জায়গাতেই আছো দেখে। কতো করে বুঝালাম, যেভাবে জীবনকে চিন্তা করছো সেটা ঠিক রাস্তা নয়, তবুও ভাবনার কোন পরিবর্তন নেই।
তুমি যে পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছো, এমন অহরহই লোকজন হচ্ছে বরং বুদ্ধিমানের মতো টাকাটা অই ডাকাতটাকে দিয়ে এসেছো, তাই ভালো।
তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে পুরু দেশটা, আর তুমিই কিনা এরকম বাজে চিন্তা করছো। তোমার মধ্যে যে প্রতিভা আছে সেটাকে মানবতার উপকারে লাগানোর চেষ্টা করো, দেখবে দিনশেষে জীবন অনেক অর্থবহ হবে।

এভাবে মাঝেমধ্যেই কথা হতে থাকে। আমার উদ্দেশ্য ছিলো, ছেলেটি যেহেতু আমার প্রতি দুর্বল, আমাকে সমীহই করে, বাচ্চা ছেলে! ক্ষোভ থেকে অনেক সময় মানুষ বেপরোয়া হয়ে যায়, তাই তার সুখদুঃখের কথা এড়িয়ে না গিয়ে শুনতাম, হয়তো তাতে সে শান্তি পেতো।
কিন্তু.. অভিজিৎ রায়ের মারা যাওয়াকে কেন্দ্র করে ছেলেটির প্রতিক্রিয়া দেখে আমি একটু আহতই হই। একটু যেনো খটকাও লাগে। এরপর তার বন্ধুতালিকার বিভিন্ন জনের সাথে কথোপকথনের ধরন দেখে আমি তাকে রীতিমতো কট্টরপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল হিসাবেই আবিষ্কার করলাম। অনুমান করলাম, সে অনেকটাই ধর্মান্ধের ঘেরাটোপে আবদ্ধ।
উপলব্দিতে আসলো, যে অলরেডি ধর্মান্ধতার আফিমে আচ্ছন্ন, তার সে নেশা কাটানো কি আদৌ সম্ভব?

(-3 খুব খারাপ লাগছিলো (-3 , তবুও তাকে ফেবুলিস্ট থেকে সরিয়ে দিলাম (-3 ।
ভুল কি কিছু করেছি???

0 Shares

২৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ