ভয়ংকর সুন্দর
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর লেখা কাকাবাবু সিরিজের প্রথম বই ভয়ংকর সুন্দর। ঠিক করেছি এই সিরিজের সবগুলি বইয়ের রিভিউ লিখব। দুই লাইনে নামকাওস্তে রিভিউ আমি লিখতে পারিনা বলে লেখা শেষ হলে দেখি বিশাল বড় হয়ে গেছে। পড়তে একটু সময় লাগবে তবে পুর কাহিনী সংক্ষেপ পেয়ে যাবেন একটা রিভিউয়েই।

কাহিনী সংক্ষেপঃ
কাকাবাবু অনেক দিন আগে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় তার একটা পা হারান। তাছাড়া কাকাবাবুর চোখে অনেক পাওয়ারের চশমা ব্যবহার করতে হয়, চশমা ছাড়া তিনি কিছুই দেখতে পারেন না। তিনি চুরট খান এবং উনার একটা লাইসেন্স করা রিভলভার আছে। সন্তু কাকাবাবুর চেলা এবার ক্লাস এইটে পড়ে।

ভয়ংকর সুন্দর গল্পে সন্তু ও কাকাবাবু গেছেন কাশ্মীরের পহেলগ্রামে, থাকছে তাবুতে। প্রতিদিনই কাকাবাবু সন্তুকে নিয়ে চলে যান সোনমার্গ, সেখানে ফিতে নিয়ে কি কি দূরত্ব মাপেন। সকলে জানে কাকাবাবু গন্ধকের খনি খুঁজছেন।

সূচা সিং কাশ্মীরের প্রভাবশালী লোক, কাকাবাবুকে খুব খাতির করে, কিন্তু বিচিত্র কোন কারণে কাকাবাবু তাকে পছন্দ করেন না। সন্তু আর কাকাবাবু বাসের অপেক্ষায় বসে আছে এমন সময় সূচা সিং কাকাবাবু কে জিজ্ঞাস করলো যা খুঁজছেন তা পেয়েছেন কিনা। কাকাবাবু জানালো কোন কিছুই পাওয়ার আশা খুব কম। সূচা সিং এর ধারনা এখানে গন্ধক না বরং সোনার খনি আছে। সূচা সিং এর ধারনা কাকাবাবু আসলে গন্ধকের নাম করে সোনার খনিই খুঁজছেন। গন্ধকের কথা সন্তুরও বিশ্বাস হয় না। সন্তুর ধারনা কাকাবাবু সোনার খনিই খুঁজছেন। কিন্তু কাকাবাবুর সাথে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি শুধু বললেন যে আসলে তিনি সোনা নয় বরং একটা চৌক পাতকুয়া খুঁজছেন।

কাকাবাবু ও সন্তু গিয়েছে সোনমার্গের একটা ছোট্ট টিলায়। সেখানে কাজ করার সুবিধার জন্য ওরা তার কাছেই ছোট্ট একটা পাহাড়ি গ্রামে গিয়ে উঠলো। রাতে ঘুমানোর সময় সন্তু বিচিত্র এক শব্দ শুনতে পায়। মনে হয় যেন তাদের ছোট্ট ঘরের জানলার কাছেই কেউ একজন এক যায়গায় দাঁড়িয়ে ঘোড়া ছুটাচ্ছে। দ্বিতীয় দিন রাতেও একই শব্দ শুনে সন্তু কাকাবাবুকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। কাকাবাবু তার রিভলভার নিয়ে দরজা খুলে বাইরে গেলেন দেখতে, কিন্তু সাথে সাথে শব্দ বন্ধ হয়ে গেল, কিন্তু তিন ঘরে ঢুকে দরজা লাগাতেই আবার শব্দ শুরু হল। পরদিন সকালে গায়ের লোকদের সাথে আলাপ করে জানা গেলো তারাও মাঝে মাঝে এই শব্দ শোনেন। তারা বলল অনেক আগে হাকো নামের একজন রাজার চিঠি নিয়ে যাচ্ছিলো। তখন তাকে শত্রুরা কুয়াতে ফেলে দিয়ে হত্যা করে। তারপর থেকেই হাকো এই ভাবে ঘোড়া ছুটাচ্ছে। হাকো খুবই সুদর্শন যুবা, কিন্তু তার চোখ দিয়ে আগুণ বের হয়, তার চোখের দিকে তাকালে জ্বলে-পুরে ছারখার হয়ে যেতে হয়, তবে সে সাধারণত কারো কোন ক্ষতি করে না।

কাকাবাবু চেষ্টা করলেন কুয়ার ব্যাপারে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে কিছু জানতে, কিন্তু তারা সে সম্পর্কে কিছুই বলতে পারলো না।

এদিকে রাতে আবার সেই শব্দ হতে থাকে। কদিন পরে কাকাবাবু আর সন্তু গেলেন জঙ্গলের দিকে। সেখানে হটাত করেই সন্তু একটা ঝোপে ঢাকা কুয়ার মধ্যে পা পিছলে পড়ে যায়। পরে কাকাবাবু উপরে একটা দড়ি বেধে তিনিও নিচে নেমে আসেন। এই কুয়াটার মুখ চৌক, আর কাকাবাবু একটা চৌক পাতকুয়া খুঁজছেন। কাকাবাবুর ধারনা এটাই সেই কুয়া। কুয়ার নিচে একটা সুড়ঙ্গ আছে। সুড়ঙ্গের ভিতরে ছিল মস্ত বড় এক সাপ। সাপটাকে গুলি করে মেরে কাকাবাবু আর সন্তু সুড়ঙ্গের ভিতরে গিয়ে দেখল সেখানে একটা কঙ্কাল পরে আছে, তার সাথে আছে বড় একটা বর্শা আর একটা চৌক তামার বাক্স। বাক্সটা নিয়ে ওরা দ্রুত কুয়ার বাইরে বেরিয়ে এলো। বাইরে বেরিয়ে তামার বাক্স খুলে তার ভিতরে শেওলা ধরা একটা পাথর দেখে সন্তুর মন খারাপ হয়ে গেল। কাকাবাবু পাথরা নিয়ে পরিষ্কার করল। পরে সন্তু দেখল পাথরটা আসলে একটা মূর্তির মুণ্ডু। মুণ্ডুটির ভিতরটি ফাঁপা সেখানে কি সব লেখা আছে। কাকাবাবু জানালেন তিনি এই মুণ্ডুটির খোঁজেই এতদিন ধরে করছেন। সম্রাট কণিষ্কের মূর্তির মুণ্ডু এটি, তার সম্পর্কে অনেক কথা লেখা আছে এটার ভিতরে। সম্রাট দেখতে কেমন ছিল এতদিন সেটা কেউ জানত না, এই মুণ্ডুর কল্যাণে এবার সবাই সেটা দেখতে পাবে। ইতিহাসের জন্য এটা অনেক বড় আবিষ্কার। চাইনিজ এক পাগলের ডাক্তারের লেখা বইতে পড়ে আর প্রচলিত গল্প উপকথা থেকে কাকাবাবুর ধারনা হয় মুণ্ডুটি কাশ্মীরে আছে, তাই তিনি সন্তুকে নিয়ে এখানে খুঁজতে এসেছেন।

পাহাড়ি গ্রাম থেকে মুণ্ডু নিয়ে ফেরার পথে কোন বাস বা জীপ গাড়ি না পেয়ে শেষ পর্যন্ত সূচা সিং এর সাথে দেখা হতে তার গাড়িতে করেই কাকাবাবু ও সন্তু পহেলগ্রাম ফিরে আসে। কথায় কথায় সূচা সিং জানতে চায় কাকাবাবু কি পেয়েছেন। অনেক চাপাচাপি করাতে সন্তু মুখ ফসকে বলে ফেলে একটা পাথর পেয়েছে। সূচা সিং পাথরটি বারবার দেখতে চায়, কিন্তু কাকাবাবু দেখতে দেন না। সূচা সিং এর ধারনা হয় ওরা পাথরে করে সোনার নমুনা নিয়ে যাচ্ছে।

পহেলগ্রাম ফিরে মুণ্ডুটি ট্রাংকে রেখে সন্তুকে তার পাহারায় বসিয়ে কাকাবাবু যান পোষ্ট অফিসে। সন্তু তাবুতে বসে বই পড়তে থাকে। দেখতে দেখতে দিন শেষ হয়ে রাত নেমে আসে তবুও কাকাবাবু ফেরেন না। সন্তু ভাবনায় পরে যায়, তবুও তাঁবু থেকে বেরিয়ে কাকাবাবুকে খুঁজতে যেতে পারে না, কারণ ট্রাংকে রয়েছে মুণ্ডুটি। চিন্তিত মন নিয়ে সন্তু একসময় ঘুমিয়ে পরে। রাতে হটাত করেই ঘুম ভেঙ্গে যায়, দেখে ঘরে তিন জন লোক দাঁড়িয়ে। একজন সন্তুর মুখ চেপে ধরে। বাকিরা তার মুখে কাপর গুজে দিয়ে হাত পা বেধে ফেলে। তারা সারা তাঁবু তন্ন তন্ন করে কি যেন খুঁজতে থাকে। ওরা মুণ্ডুটি যে বাক্সে রাখা ছিল সেটা নিয়ে চলে যায়। যে লোক সন্তু মুখ চেপে ধরেছিল তাকে সন্তু চিনতে পারে, সে হচ্ছে সূচা সিং। সন্তু অনেক কষ্টে ছুড়ি দিয়ে আসতে আসতে তার হাতের বাধন কেটে নিজেকে মুক্ত করে।

পাহাড়ি গ্রামে যাওয়ার সময় সন্তু তার বান্ধবী ও তার বড়বোন এবং তার স্বামী সিদ্ধার্থ দের সাথে দেখা হয়েছিলো, তারা তখন অন্য দিকে বেড়াতে যাচ্ছিলো। সকাল হতে সন্তু তাদের খুঁজতে গেলো, কিন্তু তারা যে হোটেলে উঠেছিলো সেখানে গিয়েও কোন খবর পেলো না। কিন্তু বাস স্টপ গিয়ে সন্তু সিদ্ধার্থদার দেখা পেয়ে গেলো, তারা বাসে করে শ্রীনগর যাচ্ছে। সন্তু সিদ্ধার্থকে সব খুলে বলল। সিদ্ধার্থ মেয়েদের শ্রীনগর পাঠিয়ে দিয়ে সন্তুকে নিয়ে প্রথমেই গেলো পুলিশের কাছে। পুলিস ওদের কথা শুনে কাকাবাবুর খোঁজ করা শুরু করলো। এদিকে ওরা জানতে পারলো সূচা সিং গ্রামের বাইরে গেছে। ওরা খুঁজে খুঁজে সূচা সিং এর বাড়িতে গেলো সেখানে তার স্ত্রীর সাথে কথা বলে জানতে পারলো সূচা সিং এর একটা বাড়ি আছে দেওগির, সেখানে সে গেছে। পুলিশকে এই কথা জানাতে তারা খুব একটা গা করলো না। সিদ্ধার্থ আর সন্তু নিজেরাই গেলো দেওগির। সেখানে গিয়েই তারা কাকাবাবুর একটি ক্রাচ দেখতে পেলো সরু রাস্তার ধারে পরে আছে। রাস্তা ধরে কিছু দূর গিয়ে একটা দোতালা কাঠের বাড়ি দেখতে পেল, সেখানে আরেকটি ক্রাচ পেল তারা। বাড়িটাতে বেশ কয়েকটি ঘর আছে, সেখানে একটা ঘরে কাকাবাবুকে খুঁজে পেলো ওরা। কিন্তু কাকাবাবুকে উদ্ধার করতে গিয়ে ওরাও বন্দি হয়ে গেলো কাকাবাবুর সাথে। কাকাবাবু জানালেন সেদিন সকালে পোস্ট অফিসে যাওয়ার সময়ে একটা গাড়ি করে দুজন লোক এসে তাকে জোর করে ধরে নিয়ে আসে।

সূচা সিং কাকাবাবুর কথা কিছুতেই বিশ্বাস করল না। তার ধারনা হল মুণ্ডুতে সাংকেতিক ভাষায় গুপ্ত ধনের নকশা লেখা আছে বা এটা স্বর্ণের নমুনা পাথর। সূচা সিং কাকাবাবুদের তিন জনকে ঘরে আটকে রেখে মুণ্ডুটি নিয়ে জম্মু তার এক বন্ধকে দিয়ে পরীক্ষা করাবে বলে গাড়ি নিয়ে চলে গেলে। এ কথা শুনে কাকাবাবু অস্থির হয়ে গেলেন, শেষে তারা তিনজনে মিলে দরজা ভেঙ্গে বেরিয়ে এলো। বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে তার একটি আর্মির ট্রাক থামালেন। অনেক কষ্টে দায়িত্বে থাকা কর্নেলকে বুঝাতে পারলেন মুণ্ডুটার গুরুত্ব, শেষে কর্নেল রাজি হল তাদের নিয়ে সূচা সিং এর পিছু নিতে। অনেকটা পথ চলার পরে ওরা সূচা সিং এর গাড়িটি দেখতে পেলো। পাহাড়ি রাস্তায় অনেক কষ্টে একেবারে সূচা সিং এর গাড়ির কাছাকাছি চলে যায়। পাহাড়ি পথের উলট দিক থেকে অনেকগুলি গাড়ি আসার কারণে সূচা সিং বাধ্য হয় গাড়ি থামাতে। গাড়ি থামিয়ে মুণ্ডু রাখার বাক্সটি নিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। কাকাবাবুরাও তার পিছু নেয়।

শেষ পর্যন্ত উঁচু এক ঢালে সূচা সিং থামতে বাধ্য হয়। ঢালটার নিচেই বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী। সূচা সিং কাকাবাবুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া রিভলভার বাগিয়ে ধরে কাকাবাবুদের দিকে, কিন্তু কর্নেল আর তার লোকের হাতে অস্ত্র দেখে সে দমে যায়। শেষ পর্যন্ত সূচা সিং ভয় দেখায় তার কাছে আসলে বা তাকে ধরতে গেলে মুণ্ডুটা সে নদীতে ফেলে দিবে। এই সমস্ত কথার ফাকে সিদ্ধার্থ লাফিয়ে পরে সূচা সিং কে ধরে ফেলে। ধস্তাধস্তির ফাকে সূচা সিং মুণ্ডসহ বাক্সটি ছুড়ে ফেলে নিচের নদীতে। আর ঢাল থেকে গড়িয়ে পরে সিদ্ধার্থ ও সূচা সিং দুজনেই আহত হয়। সিদ্ধার্থকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আর সূচা সিংকে পুলিশে নিয়ে যায়। অন্য দিকে নদীর চার ধারে অনেকটা যায়গায় জুড়ে বাক্সটাকে খুঁজে বেরান কাকাবাবু, কিন্তু খুঁজে পান না।
সমাপ্ত

প্রথম প্রকাশ: ঝিঁঝি পোকা

এখনো অনেক অজানা ভাষার অচেনা শব্দের মত এই পৃথিবীর অনেক কিছুই অজানা-অচেনা রয়ে গেছে!! পৃথিবীতে কত অপূর্ব রহস্য লুকিয়ে আছে- যারা দেখতে চায় তাদের ঝিঁঝি পোকার বাগানে নিমন্ত্রণ।

0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ