এই লেখাটা সোনেলা ব্লগে প্রকাশিত আমার প্রথম লেখা। ব্যাতিক্রম ছাড়াই লেখাটা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল বাংলাদেশের উপর। স্পেসিফিক ভাবে বলতে গেলে এই লেখাটি মুক্তিযুদ্ধকালীন বুদ্ধিজীবি হত্যাকারী চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের ব্যাপারে আদালতের দেয়া রায়ের একটি আইনী পর্যবেক্ষন। যদিও এখানে রায় ব্যাতীত সংশ্লিষ্ঠ অনেকগুলো ইস্যু আলোচিত হয়েছে। লেখাটি দীর্ঘ। সর্বমোট ১৮,৪৩৩ শব্দের। এমন একটি লেখা লেখা প্রথমত সময় সাপেক্ষ, দ্বিতীয়ত ভয়ানক পরিশ্রমের। যেমন এই লেখা লিখতে আমার মোট সময় লেগেছে প্রায় এক সপ্তাহের মত। জানি ব্লগে এত দীর্ঘ লেখা কেউ পড়েন না, ইনফ্যাক্ট এত দীর্ঘ লেখা পড়বার সময় আমাদের কারো হাতেই নেই সম্ভবত। তারপরেও লিখে গেছি দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের মূল হোতা চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের ব্যাপারে অনলাইনে তথ্যের পরিমাণ সীমিত। এত বড় দুই খুনীর ব্যাপারে কিংবা তাদের বিরুদ্ধে আসা রায়ের ব্যাপারে সবাইকে জানানো তাই কর্তব্য বলেই মনে করেছি। লেখাটা আপনাদের কাজে লাগলে কিংবা এই লেখা পড়ে আপনারা কেউ উপকৃত হলে আমার এইসব পরিশ্রম স্বার্থক মনে হবে। সোনেলার ব্লগারদের অনেক ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা।

শুরুর কিছু কথাঃ দুইটি প্রেক্ষিত

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কৃত নানাবিধ আন্তর্জাতিক অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছর পর বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলো অন্যতম অভিযুক্ত চৌধুরী মইনুদ্দিন এবং তারই আরেক সহযোগী আশরাফুজ্জামান খান। অভিযুক্ত দুইজনই তাদের বিচারের সময়কালীন  পলাতক ছিলো বলে তাদের বিরুদ্ধে প্রদত্ত রায়েই বলা রয়েছে। স্বাধীনতার পর পর চৌধুরী মইনুদ্দিন পালিয়ে চলে আসে যুক্তরাজ্যে এবং আশরাফুজ্জামান পালিয়ে চলে আসে যুক্তরাষ্ট্রে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত-২ তাদের বিচার শুরুর প্রাক্কালে তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য সম্পূর্ন আইনানুগ ভাবে ব্যবস্থা গ্রহন করে এবং তাদের দু’জনকেই যথাযথ প্রক্রিয়ায় জানাবার ব্যাপারেও পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু আলোচ্য এই দুই অভিযুক্ত কখনোই এই আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের সামনে এসে দাঁড়ায় নি। আইন যেহেতু তার নিজের গতিতেই চলে সেহেতু আদালত আইন অনুযায়ী তার কার্যক্রম চালিয়ে যায় এবং ২০১৩ সালের ৩ শরা নভেম্বর এই অভিযুক্ত দুইজনের ব্যাপারে ১৫৪ পাতার একটি রায় প্রদান করে যে রায়ে এই দুইজনকেই সর্ব্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাজ্যে প্রবাসী সাধারণ দেশপ্রেমিক নাগরিকদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একাত্তরের খুনী চৌধুরী মইনুদ্দীনকে যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবার একটি জোরদার আন্দলোন। এই আন্দলোনের নাম দেয়া হয়েছে “চৌধুরী মইনুদ্দিন এক্সট্রাডিশন ক্যাম্পেইন”।

সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিক যারা যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন, তারা সম্মিলিতবভাবেই মনে করেন যে এই অপরাধীকে দেশে ফিরিয়ে নেবার ক্ষেত্রে কিংবা আইনের শাষন সু-প্রতিষ্ঠা করবার জন্য সবাইকে আন্দলোনে নামতে হবে। সে প্রেক্ষিতে এই বছরের এপ্রিলে মইনুদ্দিনকে দেশে ফিরিয়ে নেবার দাবীতে একটি প্রাথমিক স্টিয়ারিং কমিটি ঘোষনা করা হয়। এই স্টিয়ারিং কমিটির কনভেনার হিসেবে রয়েছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক, ঐতিহাসিক ও লেখক জনাব আব্দুল গাফফার চৌধুরী এবং কো-কনভেনার হিসেবে রয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি জনাব সুলতান শরীফ।

প্রাথমিক ভাবে এই ক্যাম্পেইনের সদস্য সংখ্যা সীমিত হিসেবে থাকলেও পরবর্তীতে এই ক্যাম্পেইন মূলত অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বৃটেনের নানা শহরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং সেসব স্থানেও নানান দলে বিভক্ত হয়ে সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিকেরা এই একাত্তরের খুনীকে দেশে ফিরিয়ে নেবার দাবীতে এখন একযোগে কাজ করে যাচ্ছেন।

কিন্তু আজ এই লেখার তারিখ থেকে রায় ঘোষনার দিন হিসেব করলে দেখা যায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দেয়া রায়ের আজ প্রায় ১ বছর ১ মাসেরও বেশী সময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। আসামীরা এই রায়ের প্রেক্ষিতে যেহেতু উচ্চ আদালতে কোনো আপীল আবেদন করেনি সেহেতু এই রায় কার্যকরে সরকারের আর কোনো আইনগত বাঁধা নেই। কিন্তু, এই মামলায় বাস্তবতা খানিকটা ভিন্ন। এই দুই ভয়াবহ খুনী যেহেতু বাংলাদেশের বাইরে পলাতক অবস্থায় রয়েছে সেহেতু বিচারের রায় কার্যকরে স্বাভাবিক ভাবেই থমকে রয়েছে।

একাত্তরের এই দুই ভয়াবহ খুনীদের মামলার রায় প্রকাশ হবার পর থেকেই তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ কিংবা চলমান বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে নানান বিরুদ্ধ মতামত এসেছে। কোনো কোনো ব্যাক্তি বা গোষ্ঠী থেকে এও বলা হয়েছে যে অভিযুক্তদের অনুপস্থিতিতে বিচার কতটুকু সঠিক কিংবা যৌক্তিক হয়েছে?

উপরে উল্লেখিত যুক্তরাজ্যে চালু হওয়া চৌধুরী মইনুদ্দিন এক্সট্রাডিট ক্যাম্পেইন এবং বিচার নিয়ে  বিরুদ্ধ মতামত, এমন দুইটি প্রেক্ষিত থেকেই এই বিষয়ে উত্তর দেবার প্রয়োজন অনুভব করেছি। সে কারনেই আমার আজকের এই লেখাটির সুত্রপাত। এই লেখাটিতে আমি যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবার যথাসাধ্য চেষ্টা করব সেগুলো হচ্ছে-

১) মুক্তিযুদ্ধকালীন বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড এবং তার মনস্তাত্বিক কারন

২) একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচার শুরু এবং তার স্থগতিকরণ এবং ৩৯ বছর পর আবার বিচার শুরুর পদক্ষেপ

৩) কেন চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খান এর বিচার করাটা অত্যন্ত অপরিহার্য্য ছিলো?

৪) চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের অনুপস্থিতে তাদের যৌথ বিচার কি আইনসম্মত হয়েছে?

৫) চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ গুলো

৬) চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিচারঃ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রায়ের একটি আইনী পর্যবেক্ষণ

৭) চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিচারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, আন্তর্জাতিক মান ও নিরপেক্ষতার একটি অনুসন্ধানী পর্যবেক্ষন

৮ ) ফেয়ার ট্রায়াল প্রশ্নে বিবাদীদের মধ্যে অসাঞ্জস্যতা

৯) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালস আইন-১৯৭৩ এ রক্ষিত অভিযুক্তের অধিকার গুলো নিয়ে একটি বিশ্লেষন

১০) চৌধুরী মইনুদ্দিনকে যুক্তরাজ্য এবং আশরাফুজ্জামান খানকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে নেবার ব্যাপারে আইনী বিষয়াদির পর্যবেক্ষণ, ইত্যাদি।

১১) আন্তর্জাতিক অপরাধের ক্ষেত্রে বিচারকেন্দ্রিক মূল আইনী কাঠামো, কন্টেন্ট বিবেচনা ও এই মামলায় তার প্রয়োগ

১২) সাবজেকটিভ এলিমেন্ট এবং অবজেকটিভ এলিমেন্ট অফ আ ক্রাইম

মুক্তিযুদ্ধকালীন বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড এবং তার মনস্তাত্বিক কারন

মহান মুক্তিযুদ্ধ সময়কালীন বিজয়ের ঠিক দ্বার প্রান্তে যখন বাঙালী জাতি, ঠিক তার দু’দিন আগে অর্থ্যাৎ ১৪-ই ডিসেম্বর একাত্তরের ঘাতকেরা বাংলাদেশের সবচাইতে মেধাবী বিভিন্ন পেশাজীবি কিংবা সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে বলতে হয় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় যারা বাংলাদেশকে সব সময় প্রগতির দিকে, মননশীলতার দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের রাতের আঁধারে ধরে নিয়ে গিয়ে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। এটি অত্যন্ত সহজেই অনুমেয় যে এই বর্বর হত্যাকান্ড ছিলো পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাঙালী জাতি গোষ্ঠীর উপর চলমান নয় মাস ব্যাপী নিধনযজ্ঞের একটি অংশ এবং যেটি অবশ্যই ছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের বাংলাদেশী দালালদের সমন্বিত পূর্ব পরিকল্পনার আরেকটি অংশ যার ব্যাপারে মূলত কোনো সন্দেহ-ই নেই।

মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ টি মাসে সারা দেশ জুড়ে এত নারকীয় ও নির্বিচারে এমন বৃহৎ রেঞ্জে নৃশংস ও বর্বরোচিত উপায়ে দেশের আপামর জনসধারণকে খুন করবার পর সুনির্দিষ্ট ভাবে খুঁজে খুঁজে দেশের এই বুদ্ধিবৃত্তিক, মননশীল, প্রগতিশীল ও সুনির্দিষ্ট কিছু পেশাজীবি ব্যাক্তিদের খুন করবার পুরো ব্যাপারটি একটি মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যার দাবী রাখে।

উপরে উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর প্রেক্ষিতে এবং মনস্তাত্বিক ব্যখ্যার প্রসঙ্গক্রমে খুব সহজ অর্থে বলা যায় যে একটি জাতি আসলে মননশীলতা ও প্রগতির পক্ষে এগিয়ে যায় সেই দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণীভুক্ত ব্যাক্তিদের উদ্ভাবিত কিংবা উত্থাপিত সৎ চিন্তাপ্রক্রিয়ার প্রায়োগিক মাধ্যমগুলোর বিভিন্ন অংশ ধরে ধরেই। আরো সহজ করে বললে বলা যেতে পারে যে একটি দেশের শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, লেখক, শিল্পী  ইত্যাদি বিভিন্ন পেশাজীবি সমাজের যে সৎ ইন্টেলেকচুয়াল সামর্থ রয়েছে সেটি যখন একটি দেশ গ্রহন করতে শেখে তখন সেই দেশে এগিয়ে যায়। তাকে আটকে রাখা কঠিন। প্রাক মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথাগুলোও যদি বিবেচনায় ধরি, তথা ইতিহাস কিংবা ঐতিহ্যের প্রেক্ষিতও যদি বিবেচনায় আনি তাহলেও দেখা যাবে যে এই পূর্ব পাকিস্তানের এই বিভিন্ন পেশাভিত্তিক মানুষেরা তখন রাষ্ট্রের ভেতর তাঁদের চিন্তাকে বৃক্ষের শাখা আর প্রশাখার মত চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পরবর্তী সময়ে খুব সুক্ষ্ণভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে মননশীলতা, প্রগতিশীলতা কিংবা সুস্থ চিন্তার একটা বিশাল ফারাক। শিল্প, সংস্কৃতি কিংবা সাহিত্য চর্চার দিক থেকেও এই ফারাক খুব সুস্পস্ট ছিলো। পশ্চিম পাকিস্তান যখন ধর্ম ধর্ম করে অধর্মের কাজেই মূলত বেশী ব্যাস্ততায় মগ্ন ছিলো কিংবা শাষনভার করায়ত্ত করবে, ক্ষমতা দখলে রাখবে, কর্তৃত্ব নিজ হাতে রাখবে এমন একটা অসুস্থ টেন্ডেন্সি নিয়ে উচ্চকিত ছিলো ঠিক সে সময় পূর্ব পাকিস্তান মূলত আচ্ছাদিত ছিলো সংস্কৃতিতে, সাহিত্যে, শিল্পে, সংগীতে, নাট্যকলা সহ আরো নানাবিধ প্রগতিশীল চিন্তায়।

একটি দেশ হয়েও পূর্ব পাকিস্তান যেখানে সব ধর্মকে সমান সম্মান দিয়ে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ জাতিতে কিংবা সেই আদর্শে চলছিলো ঠিক তখন পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যাবসার প্রধান উপকরন-ই ছিলো ধর্ম আর বিদ্বেষ। পূর্ব আর পশ্চিম নিয়ে যেই একটি দেশ পাকিস্তান গঠিত হয়েছিলো সেই একটি দেশের একটি অংশ থেকে আরেকটি অংশ সব ক্ষেত্রেই ছিলো ভিন্ন। পূর্ব যেমন ছিলো ধর্ম নিরপেক্ষ কিংবা সেক্যুলার চিন্তার ধারক, ঠিক তার অপর পক্ষে পশ্চিম ছিলো ডানপন্থী কিংবা উগ্রপন্থীদের আখড়াস্থল। পূর্বের এমন একটা সৌন্দর্য্যমন্ডিত রূপের প্রধান যে কারগর ছিলেন তাঁরা হচ্ছেন মূলত এই সমাজেরই সেই উপরে উল্লেখিত বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণী। যারা পূর্বের ভেতর জাগিয়ে তুলেছিলেন দেশ প্রেম, ধর্মনিরপেক্ষ একটি স্থিতিশীল যৌথ সমাজ, একটি শিক্ষিত জাতিগোষ্ঠী যারা নিজেদের অধিকার, স্বাধিকার, ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, নাট্যকলা,খাদ্য প্রতিটি বিষয়েই সচেতন করে তুলতেন সমাজের মানুষদের।

খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণীগোষ্ঠীর উপর ভয়াবহ রকম ক্ষিপ্ত ছিলো পাকিস্তানী শাষক আর এই দেশেরই আলো, হাওয়া,জলে বেড়ে ওঠা কিছু মানুষ। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে যখন এই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের এই দেশীয় দালালরা স্পস্টত অনুধাবন করতে পেরেছিলো যে বাংলাদেশের জন্ম অবধারিত এবং যেহেতু তারা তাদের পেয়ারা পাকিস্তানকে রক্ষা করতেই পারবেনা এবং বাংলাদেশকেও রোধ করতে পারবে না সুতরাং এই দেশ যেন তাঁর এই শৈশবকালীন সময় অভিভাবকহীন অবস্থায় বেড়ে ওঠে এবং দীর্ঘ সময় লাগিয়ে দাঁড়াতে শেখে, সেই পরিকল্পনা থেকেই তারা ১৪-ই ডিসেম্বর হত্যা করে বাংলাদেশের সব মেধাবী বুদ্ধিজীবিদের। এই বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করতে গিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দোসর জামায়াতে ইসলাম তাদের ছাত্র উইং ছাত্র সঙ্ঘের আরেকটা বিবর্তিত রুপ আল-বদর দিয়ে এই নির্মম, বর্বর ও নৃশংস হত্যাকান্ড পরিচালিত করে। আমি আগেই বলেছি এই হত্যা ছিলো পরিকল্পিত ও ঠান্ডা মাথার আর বাংলাদেশকে সহজেই যেন উঠতে না দেয়া যায়, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই যেন এই দেশ আর এই দেশের মানুষ মননশীলতা, প্রগতিশীলতা কিংবা সৎ চিন্তার কাছাকাছি না আসতে পারে, এটিই ছিলো পাকিস্তানী হানাদার আর তাদের এই দেশীয় দোসরদের প্রধান চিন্তা।

একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচার শুরু দালাল আইনে এবং তার স্থগতিকরণ এবং ৩৯ বছর পর আবার বিচার শুরুর পদক্ষেপ

১৯৭২ সালে শুরু হওয়া দালাল আইনের মাধ্যমে সে সময়ে শুরু হয়েছিলো একাত্তরের ঘাতকদের বিচার। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দালালীর জন্য ১৯৭২-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আটক হয় - ৩৭ হাজার ৪ শত ৯১ জন। সারা বাংলাদেশে ট্রাইবুনাল গঠিত হয়- ৭৩ টি। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত উক্ত ট্রাইবুনাল গুলোতে দায়ের করা মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয় মোট ২ হাজার ৮ শত ৪৮ টি মামলা। দোষী প্রমাণিত হয় - মোট ৭৫২ জন, মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হয়ঃ প্রায় ২০ জনেরও বেশী, মামলায় খালাশ পায় - ২ হাজার ৯৬ জন। আইনগত ব্যাবস্থায় দ্রুততা আনার জন্য সে সময় ৭৩ টি ট্রাইবুনালের ব্যাবস্থা করা হলেও প্রতিদিন ৩-৪ টির বেশী মামলা নিষ্পত্তি সম্ভব হয়নি এবং মাসে যার পরিমাণ ছিলো ১৩০ টির মত মামলা । 

নানান ধরনের রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা, রাজনৈতিক নানান হিসেব আর নিকেশে শেষ হতে পারেনি সেই ১৯৭২ সালের দালাল আইনে অপরাধীদের বিচার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘাতকেরা স্বপরিবারে হত্যা করবার পর কার্যত দালাল আইন মুখ থুবড়ে পড়েছিলো এবং পরবর্তী সরকারের সময়গুলোতে এই আইন বন্ধ করেই কেবল সামরিক শাসকেরা ক্ষান্ত হয়ে থাকেনি বরং একাত্তরের ঘাতকদের এই বাংলাদেশেই মন্ত্রী করে দেয়া হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু নিহত হবার আগ পর্যন্তও কিন্তু দালাল আইনে যথারীতি বিচার চলছিলো যদিও ১৯৭৩ সালের ৩০ শে নভেম্বর বঙ্গবন্ধু একটি সাধারণ ক্ষমার ঘোষনা দেন দালাল আইনে আটককৃত সেইসব ব্যাক্তিদেরকে, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিলো না।

বঙ্গবন্ধুকে নিহত করবার ঠিক আগ পর্যন্ত, মানে ১৯৭৫ সালের ২০ শে এপ্রিল পর্যন্ত দালাল আইনে ৭৫২ জন ব্যাক্তি দন্ডিত হয়। যাদের মধ্যে প্রায় ২০ জনেরও বেশী ফাঁসির আসামী ছিলো। ১৯৭৫ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর বিচারপতি সায়েমের সরকার দালাল আইন বাতিল করে দালালদের বিচার বন্ধ করে দেয়। যদিও বলা হয়ে থাকে যে বিচারপতি সায়েমের আমলেই এই দালাল আইন বন্ধ করে দেয়া , কিন্তু এক কথা সকলেই জানেন যে সে সময়ে মূলত বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছিলো তৎকালীন আর্মি চিফ জিয়াউর রহমানের নির্দেশেই। জিয়া’র নির্দেশেই যে দালাল আইন বাতিল করে দেয়া হয় তার প্রমাণ আমরা পাই জিয়ার শিক্ষামন্ত্রী এম এন হুদার সাক্ষাৎকার থেকেই। যেই সাক্ষাৎকারটি  অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমেদ নিয়েছিলেন ৭-৮-১৯৮৮। এই সাক্ষাৎকারটি লিপিবদ্ধ রয়েছে কথ্য ইতিহাস, জাতীয় জাদুঘর প্রকল্পে যা পরবর্তীতে বই হিসেবে প্রকাশিত হয় লেখক মোহাস্মদ সেলিমের সম্পাদনায়। বইটির নাম ছিলো তিন রাষ্ট্রপতির আত্নকথন। জিয়ার এই নির্দেশের কারনেই যে দালাল আইন রদ করে দেয়া হয়েছিলো তা অবশ্য একই বইয়ে জানিয়েছে বিচারপতি সায়েম নিজেই। আজকের মূল আলোচনা যেহেতু এই ১৯৭২ সালের দালাল আইন কেন্দ্রিক নয় সেহেতু এই বিষয়ে এখানে আর বিস্তারিত বলছিনা।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যেসব ব্যাক্তি, গোষ্ঠী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অপরাধের সাথে যুক্ত ছিলো, তাদের বিচার বাংলাদেশ সরকার একটি নিরপেক্ষ এবং দেশীয় ব্যবস্থায় ট্রাইবুনাল  এর মাধ্যমে অত্যন্ত সুচারু ও সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি মুক্ত রেখে শুরু করেছে। ২০১০ সালের ২৫ শে মার্চ একটি গ্যাজেট নোটিফিকেশানের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে ট্রাইবুনাল এবং ২৬ শে জুলাই ২০১০ সালে শুরু ট্রাইবুনালের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। এরপর ২০১২ সালের ২২ শে মার্চ শুরু হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত-২ এর কার্যক্রম। উল্লেখ্য যে, এই দুইটি ট্রাইবুনালের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইবুনালস আইন-১৯৭৩ এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইবুনালস রুলস এন্ড প্রসিজিওর-২০১০ এর মাধ্যমে।

কেন চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খান এর বিচার করাটা অত্যন্ত অপরিহার্য্য ছিলো?

উপরের প্রশ্নের ক্ষেত্রে মূলত একটি এক লাইনের উত্তরই হয়ত যথেষ্ঠ। যে কোনো খুনীর বিচার করাটাই আসলে একটি রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য্য সেই রাষ্ট্রের আইনের শাষন সু-প্রতিষ্ঠা করবার জন্যই। সুতরাং চৌধুরী মইনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান এর বিচার করাটা কেন অপরিহার্য্য ছিলো এটা বলাটা বাহুল্য মাত্র। কিন্তু তারপরেও মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের ক্ষেত্রে সে বিচারের প্রশ্ন উত্থাপিত হয় সেখানে মূলত যেসব ব্যাক্তিদের বা গোষ্ঠীর নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা এত বেশী স্পস্ট সামনে চলে আসে যেখানে শত খুনীর মধ্য থেকেও সবচাইতে নৃশংস কিংবা সবচাইতে ভয়াবহ খুনী এমন সুনির্দিষ্টকরন প্রক্রিয়া এড়ানো সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। পৃথিবীর ইতিহাসে যতবার আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার হয়েছে তার প্রত্যেকটিতেই দেখা গেছে আসামীর কাঠগড়ায় সবার আগে তাদেরই নাম আসে যাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষকতায়, বুদ্ধিতে কিংবা পরিকল্পনায় বর্বর, নৃশংস, ভয়াল হত্যাকান্ডগুলো সংঘঠিত হয়। ঠিক এমন একটি অবস্থানের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে খুব সহজেই বলা যেতে পারে যে চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খান হচ্ছে সেই দুইজন ব্যাক্তি যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের ভয়াবহতম রূপ দেখিয়েছে। তাদের অপরাধের মাত্রা এত বেশী এবং তাদের এই হত্যার পেছনে মানসিক চিন্তার গড়ন এত বেশী নোংরা ও কুৎসিত যে এসব পড়ে অনেকটা শিউরে উঠতেই হয়। এই দুইজন অভিযুক্ত ব্যাক্তি শুধু পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে একাত্ন হয়ে বাংলাদেশে খুনই সংঘঠিত করেনি বরং তারা তাদের পরাজয় নিশ্চিত জানবার পর এমনটাই আরো বেশী নিশ্চিত করতে চেয়েছে যে, বাংলাদেশ যেন তার শৈশবকালীন সময় অভিভাবকহীন কাটায় এবং এই দেশটি যেন আর এগুতেই না পারে। সে চিন্তার প্রেক্ষিতেই এই চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খান আল-বদর নামে একটি দল গঠন করে। এই দল একে একে লিস্ট করতে থাকে বাংলাদেশের ভিন্ন ভিন্ন সেক্টরের সকল মেধাবী ব্যাক্তিদের এবং রাতের আঁধারে তাঁদের ধরে নিয়ে গিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে, নির্যাতন করে হত্যা করে ফেলে রাখে রায়ের বাজার সহ বাংলাদেশের এমন অসংখ্য বধ্যভূমিতে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার কিংবা আলবদর বললে যেমন সবার আগে গোলাম আজমের নামটি সবার আগে সামনে চলে আসে ঠিক তেমনি এই গোলাম আজমের পরে সবচাইতে ভয়াবহতম ব্যাক্তির নাম উচ্চারিত হলে চৌধুরী মইনুদ্দিন আর আশরাফুজ্জামান খান এই দুই খুনীর কথা মনের অজান্তেই যেন সবচাইতে সামনের সারিতে এসে দাঁড়ায়। মুক্তিযুদ্ধকালীন তাদের অপরাধের কার্যকরন, পরিকল্পনা, নৃশংসতা এত বেশী মাত্রায় ভয়াবহ যে এই দুইজনের বিচার না হলে যেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আবেদন অনেকটাই ম্লান হয়ে উঠত, এমন কথাটা হয়ত বলাই যায়।

চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ গুলো

প্রথম অভিযোগঃ

 ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর ভোর ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার মধ্যে এই দুই জনের নির্দেশে ৭-৮ জন সশস্ত্র আলবদর সদস্য দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে চামেলীবাগের তার নিজ বাড়ি থেকে অপহরণ করে। তাকে ইপিআরটিসি’র একটি মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়নি।

২নং অভিযোগ

১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর ভোর ৪টা-সাড়ে ৪টার দিকে এই দুই জনের উপস্থিতিতে আলবদর বাহিনীর ৮-১০ জন সশস্ত্র সদস্য পিপিআই’র প্রধান প্রতিবেদক ও কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের স্টাফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হকের পুরানা পল্টনের বাসায় জোরপূর্বক প্রবেশ করে। বন্দুকের মুখে তাকে ইপিআরটিসি’র একটি মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। তার মৃতদেহও পরবর্তীতে পাওয়া যায়নি।

৩নং অভিযোগ

১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর ভোর ৬টা-সাড়ে ৬টার দিকে এই দুই জনের নির্দেশে পাঁচ-ছয়জন সশস্ত্র আলবদর সদস্য দৈনিক পূর্বদেশের প্রধান প্রতিবেদক আ ন ম গোলাম মুস্তাফাকে তার গোপীবাগের বাসা থেকে দৈনিক পূর্বদেশের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে অপহরণ করে। তাকেও ইপিআরটিসি’র একটি মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। তার মৃতদেহও পরবর্তীতে পাওয়া যায়নি।

৪নং অভিযোগ

১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর দুপুরে এই দুই জনের নির্দেশে সশস্ত্র আলবদর সদস্যরা পিপিআই’র মহাব্যবস্থাপক  ও বিবিসি’র প্রতিবেদক নিজাম উদ্দিন আহমেদের কলতাবাজারের বাসায় জোরপূর্বক প্রবেশ করে তাকে আলবদরের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে অপহরণ করে। ইপিআরটিসি’র একটি মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। তার মৃতদেহও পরবর্তীতে পাওয়া যায়নি।

৫নং অভিযোগ

১৩ ডিসেম্বর দুপুরে এই দুই জনের উপস্থিতিতে একদল সশস্ত্র আলবদর সদস্য দৈনিক শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীনকে তার নিউ সার্কুলার রোডের বাসা থেকে বন্দুকের মুখে অপহরণ করে। আলবদরের সদর দফতরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ইপিআরটিসি’র একটি মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৭ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তার অর্ধগলিত মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়।

৬নং অভিযোগ

১৩ ডিসেম্বর সকাল ৮টা থেকে পৌনে ১০টার মধ্যে এই দুই আলবদর নেতার উপস্থিতিতে পাঁচ-ছয়জন সশস্ত্র সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, ড. সিরাজুল হক খান, ড. মো. মর্তুজা, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্যের বাসভবনে জোরপূর্বক ঢুকে তাদেরকে বন্দুকের মুখে একটি মিনিবাসে তুলে নিয়ে মিরপুরের বধ্যভূমি এলাকায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। ১৬ ডিসেম্বরের পরে মিরপুর বধ্যভূমি থেকে অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, ড. মো. মর্তুজা, ড. আবুল খায়ের, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্যের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। বাকি দুই জনের মরদেহ পাওয়া যায়নি। অভিযুক্ত আশরাফুজ্জামানের নাখালপাড়ার বাসা থেকে উদ্ধারকৃত তার ব্যক্তিগত দিনপঞ্জিতে ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা’র লক্ষ্য হিসেবে অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদের নাম উল্লেখ পাওয়া যায়।

৭নং অভিযোগ

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দুপুর ১২টা-১টার দিকে এই দুই ব্যক্তির উপস্থিতিতে ৭-৮ জন সশস্ত্র আলবদর সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর বাসায় জোরপূর্বক ঢুকে পড়ে। এ সময় অধ্যাপক মোফাজ্জলের ভাই তৎকালীন বাংলা বিভাগের ছাত্র চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের মুখ ঢেকে রাখা কাপড় টেনে খুলে ফেললে তার পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যায়। এরপর জোরপূর্বক অধ্যাপককে ইপিআরটিসি’র একটি মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। শহীদ এ বুদ্ধিজীবীর মৃতদেহ পরবর্তীতে পাওয়া যায়নি। এক সময়কার ঢাবির বাংলা বিভাগের ছাত্র আশরাফুজ্জামানের দিনপঞ্জি অনুযায়ী, অধ্যাপক মোফাজ্জল ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা’র লক্ষ্য ছিলেন।

৮নং অভিযোগ

১৪ ডিসেম্বর দুপুর ১টা-দেড়টার দিকে এই দুই ব্যক্তির নির্দেশে তিন-চারজন সশস্ত্র আলবদর সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরীকে সেন্ট্রাল রোডের পৈত্রিক বাসভবনে জোরপূর্বক ঢুকে বন্দুকের মুখে অপহরণ করে। তাকে ইপিআরটিসি’র মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। শহীদ এ বুদ্ধিজীবীর মৃতদেহ পরবর্তীতে পাওয়া যায়নি। আশরাফুজ্জামানের দিনপঞ্জি অনুযায়ী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা’র লক্ষ্য ছিলেন।

৯নং অভিযোগ

১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় অভিযুক্ত দুই ব্যক্তির উপস্থিতিতে ৫-৬ জন সশস্ত্র আলবদর সদস্য দৈনিক সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সারকে কায়েতটুলীতে তার পৈত্রিক বাসভবন থেকে বুন্দকের মুখে অপহরণ করে। তাকেও ইপিআরটিসি’র মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে শহীদুল্লাহ কায়সারের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারের সন্ধান করতে গিয়ে বাহাত্তর সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুর বিহারি ক্যাম্পে গিয়ে নিখোঁজ ও শহীদ হন তার ভাই প্রখ্যাত সাহিত্যিক জহির রায়হান।

১০নং অভিযোগ

১৫ ডিসেম্বর দুপুর ২টা-৩টার দিকে এ দুই ব্যক্তির উপস্থিতিতে দুই-তিন জন সশস্ত্র আলবদর সদস্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট ডা. মো. ফজলে রাব্বিকে তার সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে বন্দুকের মুখে অপহরণ করে। তাকে ইপিআরটিসি’র মিনিবাসে করে মোহাম্মদপুরে শারীরিক শিক্ষা কলেজে আলবদর বাহিনীর সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পরে ১৮ ডিসেম্বর শহীদ এ চিকিৎসকের মৃতদেহ ওই বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করা হয়।

১১নং অভিযোগ

১৫ ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে ৩টা-৪টার দিকে সশস্ত্র আলবদর সদস্যরা এই দুই অভিযুক্তের নির্দেশে বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলিম চৌধুরীর পুরানা পল্টনের বাড়িতে জোরপূর্বক ঢুকে পড়ে। ওই বাড়ির নিচতলায় আলবদরের সংগঠক মাওলানা মান্নান থাকতেন। তার কাছে সাহায্য চেয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এরপরে তিন জন আলবদর সদস্য আলিম চৌধুরীকে বন্দুকের মুখে অপহরণ করে  ইপিআরটিসি’র মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। স্বাধীনতার পরে রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে চোখ বাঁধা অবস্থায় তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে তার স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধূরী জানতে পারেন, আলবদরের নেতৃত্বে ছিলেন চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান।

যে কয়জন বুদ্ধিজীবিদের হত্যার অভিযোগ রয়েছে চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধেঃ

চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে ১৮ জন বুদ্ধিজীবিকে নির্মমভাবে হত্যা করবার অভিযোগ রয়েছে। এই ১৮ জন বুদ্ধিজীবি হলেন-

(১) দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেন (২) পিপিআই’র প্রধান প্রতিবেদক ও কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের স্টাফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হক (৩) দৈনিক পূর্বদেশের প্রধান প্রতিবেদক আ ন ম গোলাম মুস্তাফা (৪) পিপিআই’র মহাব্যবস্থাপক  ও বিবিসি’র প্রতিবেদক নিজাম উদ্দিন আহমেদ (৫) দৈনিক শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  ১০ জন অধ্যাপক-

(৬) অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ (৭) অধ্যাপক ড. সিরাজুল হক খান (৮) অধ্যাপক ড. মো. মর্তুজা (৯) অধ্যাপক ড. আবুল খায়ের (১০)  অধ্যাপক ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন (১১) অধ্যাপক রাশিদুল হাসান (১২) অধ্যাপক আনোয়ার পাশা (১৩) অধ্যাপক ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য,

(১৪) অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী  (১৫) অধ্যাপক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরী (১৬) দৈনিক সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার (১৭) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট ডা. মো. ফজলে রাব্বি (১৮) বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলিম চৌধুরী

প্রসিকিউশনের পক্ষে যারা সাক্ষী দিয়েছেন এই ১১ টি অভিযোগের ক্ষেত্রেঃ

মাসুদা বানু রত্না, আসিফ মুনীর, সুমন জাহিদ, ডাঃ এনামুল হক খান,ডঃ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন,তাওহীদ রেজা নুর,সৈয়দ মর্তূজা নাজমুল,গোলাম রহমান দুলু,ডাঃ ফারজানা চৌধুরী নিপা,নুসরাত রাব্বি,ইফতেখার হায়দার চৌধুরী,অনির্বান মোস্তফা,পান্না কায়সার,শরীয়তুল্লাহ বাঙালী, ওমর হায়াত,রাশিদুল ইসলাম,ফরিদা বানু,ডঃ আনিসুজ্জামান,আলী সাজ্জাদ,দেলোয়ার হোসেন,শাফকাত নিজাম,শাহজাহান কবীর, আতাউর রহমান,

এছাড়া তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে দেয়া আরো চারজন সাক্ষীর জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে ট্রাইব্যুনাল। তারা হলেন- স্বাধীনতার পরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তদন্তকারী তৎকালীন এনএসআই  কর্মকর্তা সামাদ তালুকদার, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়ার চৌধুরীর ছেলে তাসলিম হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ছেলে মিশুক মুনীর ও ফেনীর বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদ।

আসামীর পক্ষের আইনজীবি আসামী্দের পক্ষে কোনো সাক্ষী আনতে সমর্থ হন নি। এব্যাপারে তিনি অসংখ্যবার চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের পরিবারের সাথে বার বার যোগাযোগ করলেও তারা এই মামলাতে সাক্ষ্য দিতে রাজী হয়নি।

মইনুদ্দিন ও আশরাফের  বিচার এক নজরে:

চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রকাশিত আদালতের রায় এবং তারও পূর্বে বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর এই বিষয়ক সূত্র ধরে জানা যায় যে তদন্ত সংস্থা ২০১১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে।  ৯ অক্টোবর ২০১২ তে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হয়। তদন্তে মুক্তিযুদ্ধকালে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যার সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। তদন্ত সংস্থা ১০ অক্টোবর তদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষীদের জবানবন্দি ও সংশ্লিষ্ট নথিপত্র রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়ে জমা দেয়।

রাষ্ট্রপক্ষ গত ২৫ এপ্রিল ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে, যেহেতু তাঁরা দুজন যৌথভাবে একই অপরাধ করেছেন, তাই তাদের বিরুদ্ধে আলাদা করে অভিযোগ না এনে একসঙ্গে ১৬টি অভিযোগ আনা হয়েছে। যদিও এই দুই আলবাদর নেতার বিরুদ্ধে ৫ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ১৬টি অভিযোগ আনা হয়েছিল আনুষ্ঠানিক অভিযোগে (ফরমাল চার্জ)। সেগুলোর মধ্যে ৪ ধরনের ১১টি গ্রহন করে অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল। অবশ্য আনুষ্ঠানিক অভিযোগে বর্ণিত মোট ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকেই হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে । ১৬টি অভিযোগকে সন্নিবেশিত করে ১১টিতে করা হয়েছে।

২শরা মে ২০১৩ সালে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে আসা নানাবিধ আন্তর্জাতিক অপরাধের অভিযোগ আমলে নেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-২ বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল- ২, ওই একই তারিখে সেই আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়, রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ, তদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষীদের জবানবন্দি এবং সংশ্লিষ্ট নথিতে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রাইমা ফেসি [আপাতঃদৃষ্টি] পাওয়া গেছে। এ দুজনের বিরুদ্ধে যৌথভাবে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগও রয়েছে। আদেশে ট্রাইব্যুনাল ওই দুজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন এবং তাঁদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন ১২ মে ট্রাইব্যুনালে জমা দিতে পুলিশকে নির্দেশ দেন।

একাত্তরের ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বুদ্ধিজীবী নিধনের যে নীলনকশা হয়েছিল, ঘাতক আলবদর বাহিনী তা বাস্তবায়ন করে। মুঈনুদ্দীন ছিলো আলবদর বাহিনীর ‘অপারেশন ইনচার্জ’, আর আশরাফুজ্জামান ছিলো ‘চিফ এক্সিকিউটর’।

পুলিশের প্রতিবেদন থেকে আদালত নিশ্চিত হয় যে আলোচ্য দুই অভিযুক্ত পলাতক এবং এই পলাতক দুই ব্যাক্তি আদালতের সামনে উপস্থিত হবে না। এমন একটি ক্ষেত্রে আদালত এদের অনুপস্থিতেই বিচারিক পরবর্তী কর্ম প্রক্রিয়া চালাবার জন্য ঘোষনা দেন। ২৭ শে মে তারিখে তাদের দুইজনের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবি আব্দুস শুকুর খান ও নিম্ন আদালতের স্পেশাল কোর্টের আইনজীবি সালমা হাই টুনিকে নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল। আদালত তারপর ১৬ ই জুন  ২০১৩ সালে চার্জ গঠনের জন্য শুনানীর দিন ধার্য করেন।

১৫ ই জুলাই ২০১৩ তারিখে আদালত এই মামলার প্রথম শুনানীর দিন ধার্য করেন। এই মামলার সম্মানিত প্রসিকিউটর সর্বমোট ২২ জন সাক্ষীকে হাজির করেন এবং ডিফেন্স কাউন্সিল এই মামলায় কোনো সাক্ষী আনতে অসমর্থ হয়। সকল সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহন শেষ হয় ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখে এবং উভয় পক্ষের চূড়ান্ত যুক্তি তর্ক শেষ হয় ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখে এবং সেদিন-ই আদালত এই মামলার রায় অপেক্ষমান রাখেন। অবশেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত-২, ২০১৩ সালের ৩ শরা নভেম্বর এই মামলার ১৫৪ পৃষ্ঠা, ৫৫৩ প্যারা ও ৮৭ হাজার ২৫৮ শব্দের রায় প্রকাশ করেন।

চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের অনুপস্থিতে তাদের যৌথ বিচার কি আইনসম্মত হয়েছে?

আগেই বলা হয়েছে যে চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিচার যে আইনে হচ্ছে সেটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) আইন-১৯৭৩। যদিও এই আইনে একাধিকবার নানাবিধ প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা হয়েছে। এই আইন কি করে কাজ করবে এবং আরো নানাবিধ প্রক্রিয়া কিংবা কার্যকরণ সমূহ স্পস্ট ও আরো নানাবিধ বিষয়াদির ব্যখ্যা করবার জন্য এই আইনের পাশাপাশি একটি রুলস এবং প্রসিজিওরও রয়েছে। এখন প্রথম অবস্থাতেই দুইটি আইনী প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রথমটি হচ্ছ দুইজন বা তারও অভিযুক্তের একই সাথে বিচার/ট্রায়াল এবং দ্বিতিয়ত অভিযুক্তের অনুপস্থিতিতে মামলা পরিচালনা। এই ট্রাইবুনালের রুলস এন্ড প্রসিজিওরের ৩৬ নাম্বার অনুচ্ছেদে অত্যন্ত স্পস্ট ভাষাতেই বলা রয়েছে যে-

A person accused of the same offence Committed in the course of the same transaction, or persons accused of abatement or attempt to commit such offence, or persons accused of conspiracy or planning or design in the commission of an offence or more than one offence, or persons accused of more than one offence may be charged with, and tried for, every such offence.

রুলস এবং প্রসিজিওরের এই বিধি-৩৬ থেকেই এই ব্যাপারটি অত্যন্ত পরিষ্কার যে, মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের বিচার একটি একক ট্রায়ালেই করা সম্ভব। আর এই উল্লেখিত আইনের প্রেক্ষিতেই কোর্ট তার রায়ের ১৮ নাম্বার অনুচ্ছেদে যৌথভাবে মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের বিচারিক কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন-

Presumably the Chief Prosecutor considering the nature, pattern of the alleged atrocious events and culpable participation and involvement of the two accused persons therewith i.e the same offences preferred to submit a single ‘Formal Charge’ with a view to prosecute them jointly. The ‘Formal charge’ submitted discloses that both the accused persons allegedly actively participated to the commission of the offences in the course of the same transaction and they appear to have allegedly acted in furtherance of common design and plan to the accomplishment of such offences and therefore both of them have been charged with and tried at one trial for every such offence

মইনুদ্দিন ও আশরাফের অপরাধের মাত্রা, ধরন, সংগঠনের সময়কাল মূলত একই। সে কারনেই বিজ্ঞ প্রসিকিউটর উক্ত দুজনের ক্ষেত্রেই একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন।  যেহেতু এই বিচারের সময় আসামীরা পলাতক ছিলো এবং তেমন একটা অবস্থাতেই এদের বিচার সম্পাদিত হয়েছে এমন একটা প্রেক্ষিতেও নানাবিধ ব্যাক্তি ও গোষ্ঠীদের কাছ থেকে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। এইসব প্রশ্নেরও আসলে নানাবিধ আঙ্গিক আর ধরন। প্রশ্নগুলোর মধ্যে রয়েছে-

 (১) মইনুদ্দিন ও আশরাফের বিচার কি আইনসম্মত হয়েছে?

(২) পলাতক মইনুদ্দিন ও আশরাফকে কি তাদের সকল অধিকার সঠিকভাবে দেয়া হয়েছে?

(৩) মইনুদ্দিন ও আশরাফের পক্ষে কেন কোনো সাক্ষী নেই?

উত্থাপিতপ্রশ্নেরজবাব:

উপরে আপনারা এরই মধ্যে দেখেছেন এই বিচারের প্রাথমিক ধাপ গুলো। যেমন মামলা হওয়া, তদন্ত হওয়া, সে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল, চূড়ান্ত অভিযোগ গঠন ও মামলা আমলে নেয়া। এসব সবকিছু ট্রাইবুনালের অন্যান্য সকল মামলার মতই পরিচালিত হয়েছে। এবার আমরা আলোচনা করব মামলা পরিচালিত হবার পরে কি কি অভিযোগ রয়েছে এই মামলার ব্যাপারে সে অভিযোগ গুলোই খণ্ডন করব।

 (১) মইনুদ্দিন ও আশরাফের বিচার কি আইন সম্মতহয়েছে কিংবা আইনের কোনো রকম বরখেলাপ কি হয়েছে?

উত্তর: হ্যাঁ, মইনুদ্দিন ও আশরাফের বিচার, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালস আইন-১৯৭৩ এবং তারা সকল বিধি ও পদ্ধতি মেনেই সঠিক ভাবে হয়েছে। কী করে সঠিকভাবে হয়েছে তার একটি আইনি ব্যাখ্যা নিচে আলোচনা করা হলো।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালস আইন-১৯৭৩ এর যেই রুলস এন্ড প্রসিজিওর রয়েছে সেই রুলস এবং প্রসিজিওরের ৪র্থ অধ্যায়ের কার্যপদ্ধতি অংশের অধীনে ২২ নাম্বার বিধিতে বলা রয়েছে:

২২ নাম্বার বিধি: অপরাধ আমলে গ্রহণের পর ট্রাইবুনাল অভিযুক্তের উপস্থিতির জন্য একটি তারিখ ধার্য করিবেন এবং এই উদ্দেশ্যে সমন বা ওয়ারেন্ট, যাহা ট্রাইবুনাল উপযুক্ত বলিয়া মনে করেন, জারী করিবেন

এই বিধি অনুযায়ী ট্রাইবুনাল মইনুদ্দিন ও আশরাফের বিচার বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নেবার পর গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেছে উপযুক্ত মনে করেই।  ২ ই মে ২০১৩ সালে তাকে গ্রেফতার করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। সুতরাং এইখানে আইনের বরখেলাপ হয়নি। আইন মেনেই তা হয়েছে। কিন্তু  পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যায় যে এই দুইজইন পলাতক রয়েছে।

 এবার আসুন দেখি এই বিধির ৫ম অধ্যায়ের ৩১ নাম্বার বিধিতে কি বলা রয়েছে-

৩১ বিধি: বিধি ২২ অনুসারে ইস্যুকৃত প্রসেস অজারীকৃত অবস্থায় ফেরত আসিলে ট্রাইবুনাল অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ধার্যকৃত তারিখে ট্রাইবুনালে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ সম্বলিত নোটিশ দুইটি দৈনিক পত্রিকায়, যাহার একটি বাংলা অপরটি ইংরেজী, প্রকাশের আদেশ প্রদান করিবেন

মইনুদ্দিন ও আশরাফের বিচার বিরুদ্ধে ইস্যুকৃত প্রসেস যেহেতু অজারীকৃত অবস্থায় ফেরত এসেছিলো কেননা মইনুদ্দিন ও আশরাফ পলাতক ছিলো সে কারণেই আদালত মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য মইনুদ্দিন ও আশরাফকে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন।

ট্রাইবুনালের এই আদেশের পর পরে যথাক্রমে গত ১৪ এবং ১৫-ই মে সেপ্টেম্বর দৈনিক জনকণ্ঠ  ও ডেইলী স্টার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। কিন্তু সেটির পরেও এই দুইজন পলাতক থাকে।

আবার আমরা বিধি -৩২ শে দেখতে পাই যে বলা রয়েছে-

দৈনিক পত্রিকাসমূহে নোটিশ প্রকাশ সত্বেও যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি নোটিশে ধার্য তারিখ সময়ে ট্রাইবুনালে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হন, এবং ট্রাইবুনালের যদি ইহা বিশ্বাস করিবার কারণ থাকে যে অভিযুক্ত ব্যক্তি পলাতক রহিয়াছেন বা আত্মগোপন করিয়াছেন এবং তাহাকে গ্রেফতার করিয়া বিচারের জন্য সোপর্দ করা যাইতেছে না তাহার আশু গ্রেফতারের সম্ভাবনা নাই, তাহা হইলে উক্ত অভিযুক্ত ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে বিচার কার্য শুরু সম্পন্ন হইবে

যেহেতু পত্রিকায় নোটিশ দেবার পরেও মইনুদ্দিন ও আশরাফ পলাতক ছিলো এবং অভিযুক্ত দ্বয় এরপরেও আদালতে আত্নসমর্পন না করে পলাতক ছিলো সুতরাং ট্রাইবুনালের এটি বিশ্বাস করারই যৌক্তিক কারন ছিলো যে অভিযুক্ত দুইজন তাদের আশু গ্রেফতারের সম্ভাবনা নেই কেননা তারা পলাতক সুতরাং আলোচ্য বিধি অনুযায়ী-ই মইনুদ্দিন ও আশ্রাফুজ্জামানের বিচার শুরু হয়েছিলো। আইন অনুযায়ী  ২৭শে মে ২০১৩ সালে ট্রাইবুনাল-২ এই মামলাতে উক্ত দুইজনের আর উপস্থিত থাকবার সম্ভাবনা নেই এই মর্মে উপনীত হয়ে বিচার শুরু করবার ঘোষনা দেন এবং আসামীদের পক্ষে দুইজন আইনজীবিকে নিয়োগ দেন।

সুতরাং আমরা উপরের আলোচনায় দেখতে পাচ্ছি যে মইনুদ্দিন ও আশরাফের বিচার একেবারেই নিয়ম কানুনের লাইন টু লাইন মেনেই মেনেই সঠিক ভাবে শুরু হয়েছে।

(২) পলাতক মইনুদ্দিন ও আশরাফকে কি তার প্রাপ্য সকল আইনী অধিকার সঠিকভাবে দেয়া হয়েছে?

যেহেতু মইনুদ্দিনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের মুখোমুখি হতে ভয় পেয়েছে এবং সেই সাহসটুকু তার নেই সেহেতু সে পালিয়ে গেছে। কিন্তু তাই বলে রাষ্ট্র কি তাকে তার প্রাপ্য আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে? উত্তর হচ্ছে,না। করেনি। চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান পলাতক থাকবার পরেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল পলাতক মইনুদ্দিন ও আশরাফের পক্ষে তাদের পক্ষে দেশের অন্যতম দুই সেরা চৌকস আইনজীবি নিয়োগ দিয়েছেন। যারা এই বিচারের এত সমালোচনা করছেন, মানবাধিকার বা নিরপেক্ষতার অযথা অজুহাত তুলছেন তারা এবার কি বলবেন? রাষ্ট্র তার নিজের খরচে, দেশের সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকা ব্যয় করে হলেও সুবিচার নিশ্চিত করবার স্বার্থেই এই পলাতক অভিযুক্তদের পক্ষে আইনজীবি নিয়োগ করেছে বিচার তার সকল অধিকার দেয়া হয়েছে। অধিকার সম্পর্কিত আলোচ্য আইনের যে বিধি রয়েছে সেই বিধির ৪৩ নাম্বারে লেখা রয়েছে-

যখন কোনো কেসের বিচারকালে কোনো অভিযুক্তকে কোনো কাউন্সিল প্রতিনিধিত্ব না করেন, তাহা হইলে সেই ক্ষেত্রে ট্রাইবুনাল সরকারি খরচে অভিযুক্তের পক্ষে একজন কাউন্সেল নিয়োগ প্রদান করিবেন

চৌধুরী মইনুদ্দিন এবং আশরাফুজ্জামানের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত-২ এর রায় পড়ে এবং পুরো ট্রায়ালের কার্যক্রম যাচাই করে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে এই আলোচ্য  বিধিও সুচারু ভাবে পালিত এবং এই দুই অভিযুক্তের অধিকার রক্ষিত হয়েছে।

(৩) মইনুদ্দিন কিংবা আশরাফুজ্জামানেরপক্ষেকেনকোনোসাক্ষীনেই?

আইনজীবী আব্দুর শুকুর খান এই সুনির্দিষ্ট ব্যাপারটিতে সাহায্য চেয়েছিলেন মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের কাছে। কিন্তু উভয় পরিবারের সদস্যরা কোনো ভাবেই মইনুদ্দিনকে এই ব্যাপারে কোনো ধরনের সাহায্য করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছিলো।

আসামীদের অনুপস্থিতিতে বিচার, ট্রাইবুনাল-২ এর অবজার্ভেশনঃ

গত ২ শরা ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত-২ একজন ব্রিটিশ নাগরিক জনাব ডেভিড বার্গম্যান নামক এক তথাকথিত সাংবাদিককে আদালত অবমাননার দায়ে সাজা দেয় এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানা করে। এর আগেও এই তথাকথিত সাংবাদিক আদালত অবমাননার দায়ে ট্রাইবুনাল-১ এর কাছ থেকে লাস্ট ওয়ার্নিং পেলেও অনবরত সে বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা এই ট্রাইবুনাল নিয়ে মিথ্যে ও বেঠিক সংবাদ পরিবেশন করছিলো। সেই সাথে সে আদালতকে হেয় প্রতিপন্ন করে একের পর  এক ব্লগ তার নিজের একটি ব্লগ সাইটে ক্রমাগত লিখে যাচ্ছিলো। এইসব অপঃকর্মের সূত্র ধরেই আদালত ডেভিডকে শাস্তি প্রদান করে। Abul Kalam Azad, Advocate, Supreme Court Bar Association Bhaban vs. David Bergman [Contemnor] Journalist,7/C, New Bailey Road, Dhaka-1000 মামলায় আদালত ইতিপূর্বে ট্রাইবুনাল-১ এ প্রদত্ত বাচ্চু রাজাকারের মামলার প্রসেডিঙ্গস নিয়ে ডেভিড বার্গম্যানের উত্থাপিত কিছু প্রশ্নের দীর্ঘ ব্যাখ্যা দেন। সেসব কয়েকটি প্রশ্নের মধ্যে আসামীর অনুপস্থিতিতে মামলা চলবার বিষয়টি উত্থাপিত হয়। এই ক্ষেত্রে আদালত বলেন-

The essence of the criticism that the contemnor made in this article is that the observation of the tribunal that the in absentia trial did not reflect international standards as has been ensured by the European Court of Human Rights and the statute of the Special Tribunal for Lebanon [STL]. The Act of 1973 provides provision of holding trial in abesntia, if the appearance of the accused could not be ensured for the reason of his absconsion [Section 10A (1) of the Act].

 In the international context, the issue of trials in absentia arose with the first modern international criminal tribunal, the International Military Tribunal (IMT) at Nuremberg, which was established to try war criminals operating under the European Axis Powers during World War II. Article 12 of the Charter of the International Military Tribunal allowed for trials in absentia whenever the Tribunal found it necessary to do so in the interest of justice. Famously, Martin Bormann, who served as the Nazi Party secretary, was indicted, tried, and sentenced to death, all in absentia, despite doubts as to whether he had even been informed of the proceedings.

 United Nations reversed its policy against trials in absentia with the Special Tribunal for Lebanon (STL or Lebanon Tribunal) in 2006. The STL allows trials "to commence and to end without an accused ever having showed up in court. The STL (Special Tribunal for Lebanon) expressly allows for trials in the absence of the accused in article 22 of the STL Statute, entitled "Trials in absentia." Article 22(1), lists the situations where the STL can hold trials in the accused absence.

According to Professor William Schabas under section 22(1) (c) of the STL Statute, the accused may be tried in absentia when he refuses to appear after an initial appearance (absconded) or is otherwise unable to be found after all reasonable steps have been taken to inform him of the proceedings including media publication and communication with his known state of residence.

 Accused Abul Kalam Azad @ Bachchu could have due opportunity of being properly informed of the proceedings in advance if the warrant of arrest could have been executed. But by remaining absconded and leaving country the accused has willfully declined to exercise his right to be present for facing trial and as such under this circumstance, trial in his absence would be permissible "in the interest of the proper administration of justice."

 উপরের এই পরিচ্ছদে অত্যন্ত স্পস্ট ভাবে আদালত তার অবস্থান অনেকগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের উদাহরন দিয়েই দেখিয়েছেন। আদালত দেখিয়েছে কি করে নুরেম্বার্গ ট্রাইবুনালে অভিযুক্ত মার্টিন বোরম্যান এর বিচার হয়েছিলো তার অনুপস্থিতিতেই। আদালত আবার স্পেশাল কোর্ট অফ লেবাননের উদাহরনও এখানে নিয়ে এসেছেন যেই কোর্টের সংবিধির ২২ নাম্বার বিধিতেই আসামীকে কোনো ক্রমেই যদি ট্রাইবুনালে হাজির না করানো যায় কিংবা আসামী পলাতক থাকে তবে কি করনীয় সেটি বর্ণিত রয়েছে যেখানে আসামীর অনুপস্থিতিতেই বিচারের কথা স্পস্ট ভাবে বলা রয়েছে। আদালত অবশ্য এইসব উদাহরন দেবার আগেই স্পস্ট বলে নিয়েছেন যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত যদিও আন্তর্জাতিক ভাবে রেকোগনাইজড অপরাধের বিচার করছে, তথাপিও এই আদালত একেবারেই জাতীয় পর্যায়ের একটি নিজস্ব আদালত। যেই আদালতের এই বিষয়ে নিজস্ব একটি আইন রয়েছে একটি পরিপূর্ন বিধি রয়েছে। উপরন্তু এই আদালতের আলোচ্য উল্লেখিত আইন বাংলাদেশ সংবিধান দ্বারাই নিশ্চয়তা প্রাপ্ত এবং এই আদালতের বিধিতেই আসামীর অনুপস্থিতিতে বিচারের কথা সু-স্পস্টভাবে লেখা রয়েছে। সুতরাং বিচার যা হয়েছে প্রথমত তা আইন মেনে হয়েছে আর দ্বিতীয়ত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আদালতে এই ধরনের বিচারের ক্ষেত্রে আসামীর অনুপস্থিতিতে বিচারের বিধান রয়েছে যা উপরে বলা হয়েছে।

পাঠক, আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে, আসামী চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানকে আদালতে আনবার কিংবা তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ব্যাপারে তারা যাতে আদালতে এসে বলতে পারেন তাদের সব অধিকার রক্ষা করে সেসব সব ধরনের সুবিধাই দেয়া হয়েছে। এরপরেও যখন অভিযুক্তরা পলাতক থাকে, আইনের চোখ ফাঁকি দিতে চায় কিংবা বিচার এড়াতে চায়, সে ক্ষেত্রে নিশ্চই ভিকটিমদের পক্ষ থেকে বিচারের যে দাবী, সেটি পরাজিত হতে পারেনা।

চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিচারঃ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রায়ের একটি আইনী পর্যবেক্ষণ

আগেই বলা হয়েছে এই বিচার একটি ঐতিহাসিক বিচার। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশের এই বিচার করবার পুরো প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রের সদিচ্ছা, প্রসিজিওর, বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে নির্মূল করবার পদক্ষেপ এসব সব কিছু মিলিয়েই এই ট্রাইবুনাল, এই আদালত, এই আইন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন নিয়ে যারা পড়েন, গবেষনা করেন, আগ্রহী তাঁদের সকলের জন্যই বাংলাদেশের এই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচার সব সময়ের জন্য অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যদিও এই ধরনের অপরাধের বিচার করবার জন্য একটা গ্লোবাল কনসেনশাস তৈরী হয়েছিলো কিন্তু তার পরবর্তী সময়ে এই ধরনের বিচার করবার জন্য অন্যান্য দেশে এই বিষয়ক আইন প্রণয়নের খুব বেশী সদিচ্ছা বা ভূমিকা তেমন আসলে দেখা যায়নি। যদিও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে যুদ্ধকালীন অপরাধের বিচার মূলত ১৪৭৪ সালেই রোমান এম্পায়ার এর সময়েই একটা এড-হক বেইজড ট্রাইবুনালে শুরু হয় পিটার ভন হেইজেনব্যাচ এর বিচারের মাধ্যমে। এরপর ১৬৫৪ সালে একই অপরাধে ইংল্যান্ডের চেশায়ারে মেজর কনট কে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রায় কার্যকর, ১৮৬৫ সালে আমেরিকার জর্জিয়ার এন্ডারসনভাইল প্রিজনে হেনরী উইরজ্‌ এর বিচার, জার্মানীর লিপজিগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালীন অপরাধের বিচার ইত্যাদি। এভাবে কালের পরিক্রমায় হেগ কনভেশন এর উদ্ভব, তারপর জেনেভা কনভেনশন, নুরেম্বার্গ ও টোকিও ট্রাইবুনাল সংবিধি-১৯৪৬, বৃটেন কর্তৃক গৃহীত জেনেভা কনভেনশন এক্ট ১৯৫৭ ইত্যাদি।

এসব সব কিছুর ধারাবাহিকতায় আমরা পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে নানাবিধ আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য দেখেছি নুরেমবার্গ ট্রাইবুনাল, টোকিও ট্রাইবুনাল, ইয়াগোস্লোভিয়া ট্রাইবুনাল, এড হক ভিত্তিতে রুয়ান্ডা ট্রাইবুনাল, সিয়েরা লিওন, ন্যাশনাল ও ইউ এন সমন্বিত ক্যাম্বোডিয়া ট্রাইবুনাল সহ নানাবিধ অন্যান্য ট্রাইবুনাল। এমনকি যুদ্ধকালীন সময়ের নৃশংসতা, বর্বরতা ইত্যাদির প্রেক্ষিতে একটি গ্লোবাল হারমোনাইজড আইনেরও প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় তীব্র ভাবে। সেই প্রেক্ষিতেই নেদারল্যান্ডের হেগে স্থাপিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। এই আদালতের যে বিধি রয়েছে সেটি রোম সংবিধি বলে পরিচিত। যদিও এই সংবিধি ১৯৯৮ সালে প্রণীত হলেও এর কার্যপ্রকরণ শুরু হয় ২০০১২ সালে। এই বিধিতে রেট্রোস্পেকটিভ আইনকে রেকোগনাইজ করা হয়নি এবং সে অনুযায়ী উক্ত কোর্ট ২০০২ সালের আগে সংঘঠিত কোনো আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার এই আদালতে করতে পারেনা। এটি আস্নতর্জাতিক অপরাধ আদালতের একটি বড় শূন্যতা বলেই বিবেচিত হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করবার জন্য যদিও পশ্চিমে অনেক আগে থেকেই একটা কনসেনশাস আস্তে আস্তে বাড়ছিলো কিন্তু আগেই বলেছি অনেক দেশ এই ধরনের বিচারকে রাজনৈতিক ভাবে দেখত কিংবা অনেক দেশ নিজেই এই জাতীয় অপরাধের সাথে সরাসরি জড়িত থাকবার কারনে কখনোই এই আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ধারনাকে প্রমোট করেনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পর পর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইন করা হয়। পশ্চিমেই যেখানে এত আগে এই জাতীয় আইন নিজস্ব জুডিশিয়ারী সিস্টেমে অন্তর্ভূক্ত-ই করা হয়নি সেখানে সেই সময়েই এই জাতীয় একটা আইন পুরো পৃথিবীর কাছেই আসলে বিষ্ময়ের ছিলো। যদিও আমাদের সংবিধানের ৩৫(১) এর অনুচ্ছেদে রেট্রোসপেকটিভ আইনের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ রয়েছে ত্যথাপিও সংবিধান মূলত যে মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে উদ্ভব এবং যেই ন্যায় বিচারের কথা সংবিধানের শুরুতেই বর্ণিত রয়েছে সেই ন্যায় বিচার এর স্বার্থেই বাংলাদেশ সরকার পরবর্তীতে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৪৭(৩) ও ৪৭(ক) অনুচ্ছেদ যুক্ত করে এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন যে আন্তর্জাতিক অপরাধ এই দেশের সাধারণ মানুষদের উপর হয়েছে সেটির বিচার করবার জন্য পথ সুগম হয় এবং ন্যায়বিচার স্থাপনের যে সদিচ্ছা রাষ্ট্রের রয়েছে সেটির ব্যাপারে একটা সু-স্পস্ট ও সু-নির্দিষ্ট ধারনা পাওয়া যায়। প্রথম সংশোধনীতে যে ৪৭(৩) এবং ৪৭(ক) অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয় সে দুইটি অনুচ্ছেদ নীচে বুঝবার সুবিধার্থে তুলে দিচ্ছি-

সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে যে-

এই সংবিধান যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফৌজদারীতে সোপর্দ কিংবা দন্ডদান করিবার বিধান-সংবলিত কোন আইন বা আইনের বিধান এই সংবিধানের কোন বিধানের সহিত অসমঞ্জস্য বা তাহার পরিপন্থী, এই কারনে বাতিল বা বেআইনী বলিয়া হবে গণ্য হইবে না কিংবা কখনও বাতিল বা বেআইনী হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে না।” 

আবার সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৭(ক) তে বলা হচ্ছে যে-

) যে ব্যাক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের () দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়, সেই ব্যাক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ, ৩৫ অনুচ্ছেদের () () দফা এবং ৪৪ অনুচ্ছেদের অধীনে নিশ্চয়কৃত অধিকারসমূহ প্রযোজ্য হইবে না

যাই হোক, উপরের আলোচনা করবার মূল উদ্দেশ্য ছিলো দুটি জিনিস ব্যখ্যা করবার। একটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিষয়ে গ্লোবালি যে স্টেপস গুলো নেয়া হয়েছে বা এটির ধারনার যে ক্রম বিবর্তন সেটি আলোচনা করা আর দ্বিতীয়ত বাংলাদেশ রাষ্ট্র ন্যায় বিচারের স্বার্থে এই ধরনের অপরাধের বিচার করবার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাদের সংবিধান সংশোধন কিংবা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সেটি তুলে ধরা। এই তুলে ধরবার পেছনেও কিছু কারন রয়েছে। এই কারন গুলোর মধ্য একটি তো ইতিমধ্যেই বলেছি যে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করন আর আরেকটি কারন হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দায় বদ্ধতা। আপনারা অনেকেই জেনে থাকবেন যে বাংলাদেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ট্রিটি’র সিগ্নেটোরী দেশ। এই পার্টিকুলার বিষয়েই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত-২ এই বিচার প্রক্রিয়ার প্রথম রায়ে, The Chief Prosecutor Vs Abul Kalam Azad  মামলার ১৫ এবং ১৬ অনুচ্ছেদে এই বিষয়ের উপর আলোকপাত করেন। আদালত বলেছিলো-

15. Bangladesh Government is a signatory to and has ratified the ICCPR, along with its Optional Protocol. It is necessary to state that the provisions of the ICTA 1973 [(International Crimes (Tribunals) Act, 1973] and the Rules framed there under offer adequate compatibility with the rights of the accused enshrined under Article 14 of the ICCPR. The 1973 Act of Bangladesh has the merit and mechanism of ensuring the standard of safeguards needed universally to be provided to theperson accused of crimes against humanity.

 16. As state party of UDHR and Geneva Convention Bangladesh cannot evade obligation to ensure and provide justice to victims of those offences and their relatives who still suffer the pains sustained by the victims and as such an ‘executive act’ (tripartite agreement) can no way derogate this internationally recognized obligation. Thus, any agreement or treaty if seems to be conflicting and derogatory to “jus cogens” (compelling laws) norms does not create any hurdle to internationally recognized state obligation.

এটি এই ক্ষেত্রে পরিষ্কার যে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যে সকল আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘঠিত হয়েছিলো সেগুলোর বিচার করা আন্তর্জাতিক ভাবে বিভিন্ন চুক্তি কিংবা মানবাধিকার রক্ষাকল্পের সিগ্নেটোরী রাষ্ট্র হিসেবে শুধু বাংলাদেশের দায়-ই কেবল নয় বরং বাধ্যতামূলক ভাবে এই বিচার করাটা বাংলাদেশের দায়িত্ব। এটি আন্তর্জাতিক ভাবে এখন মোটামুটি ভাবে স্বীকৃত যে আন্তর্জাতিক যে সকল অপরাধ রয়েছে তথা যে অপরাধগুলোকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের অধীনস্থ করা হয়েছে সেসব অপরাধ “Jus Cogens” [জাস কোজেন্স শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বাধ্যকারী আইন] থিওরীতে বিবেচ্য হবে সুতরাং এই বিবেচনা অনুযায়ী এইসব অপরাধের বিচার করাটা একটি রাষ্ট্রের জন্য অনেক বড় দায়।

অনেক উৎসের মাঝে ১৯৯৩ সালে সাবেক ইয়াগোস্লাভিয়ায় যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল এবং রুয়ান্ডায় গণহত্যা বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল গঠনকল্পে প্রণীত বিধিবদ্ধ আইনের নাম করা যেতে পারে । এই অপরাধগুলো যে “জাস কোজেন্স” এর-ই অংশ সে সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্য যথেষ্ঠ আইনি ভিত্তি বিদ্যমান রয়েছে ।

এই আইনী ভিত্তি চারটি কারণে প্রমাণিত হতে পারে-

১) International Opinio Juris (এই অপরাধগুলো সাধারণ প্রথাগত আইনের অংশ তার স্বীকৃতির ই প্রতিফলন )

২) এই অপরাধ সঙক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি

৩) যেসব কনভেনশন উল্লেখযোগ্য সঙ্খ্যক দেশ দ্বারা সমর্থিত হয়েছে

৪) যে সমস্ত অপরাধের দায়ে দোষী ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত তদন্ত ও মামলা গুলো ব্যাপক ভাবে সমর্থিত হয়েছে ।

এই জাস কোজেন্স থিওরীর সাথে আরেকটি থিওরী এখানে আলোচনার দাবী রাখে। যেটিকে বলা হয় “অবলেগেটিও এরগা ওমনেস” [Obligatio Erga Omnes] যার সরল মানে দাঁড়ায় অবশ্য পালনীয়। সুতরাং আন্তর্জাতিক অপরাধ গুলোর ক্ষেত্রে এই জাস কোজেন্স আর এরগা ওমনেস দু’টি প্রিন্সিপাল আসলে খুব সহজেই বলে দেয় এইসকল অপরাধের বিচার করবার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কতটুকু দায় রয়েছে সেটি। শুধু যে এইসব আলোচ্য থিওরীকে কেন্দ্র করে যে কেবল দায় বর্তায় তাও কিন্তু নয়। একটি সভ্য রাষ্ট্র অপরাধ হলে বিচার করবে এটাই স্বাভাবিক এবং সেটা হওয়াও বাঞ্ছনীয়। এটিকে ছাপিয়েও রয়েছে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা যেটি আমাদের সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ পড়লেই সহজে বোধগম্য হবে। এই ২৫ অনুচ্ছেদেই কিন্তু বলা রয়েছে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসঙ্ঘের নীতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা তথা পালনের কথা। আর আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনাতে সামাজিক সুবিচার, আইনের শাষন, মৌলিক মানবাধিকারের কথা বলা রয়েছে আর এই নিয়ামকগুলো তখনই ব্যার্থ হবে যখন একাত্তরের ভিকটিমেরা সুবিচার পাবেন না। সুতরাং এই বিচার করবার জন্য রাষ্ট্র জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যায়, সকল ক্ষেত্রেই বাধ্য।

উপরে আগেই একটি দীর্ঘ আলোচনা করেছি যে দুইজন অভিযুক্তকে কখন একটি একক ট্রাইবুনালে এবং কখন তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার করা যাবে। এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় সকল উদাহরনও আমি উপরে দিয়েছি। এই আইনে বিচার করবার বাধ্যবাধকতা কিংবা এই বিচারের একটি ক্রমবিকাশও উপরে আলোচনার প্রেক্ষিতে বিশদ ভাবে আলোচিত হয়েছে।

এখন আসলে এই মামলার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো দেখা দরকার সেগুলো হচ্ছে এই মামলায় বিচারিক বিভিন্ন ধরন, বিবেচনা, সাক্ষ্য, উভয় পক্ষের যুক্তি এবং সেটির প্রেক্ষিতে আদালতের বক্তব্য, এসব বিষয়গুলো কি করে তুলে ধরা হয়েছে। এই উল্লেখিত বিষয়াদির পরপরই আসলে আলোচনা করা হবে এই পুরো মামলাটিতে অভিযুক্তকে তার পাপ্য সকল সুযোগ সুবিধা কতটা এক্সটেন্টে দেয়া হয়েছে কিংবা ভিকটিম পরিবার বা অভিযুক্ত যদি বিচার থেকে প্রাপ্য ফলাফলে তুষ্ট না হন তবে তাদের সেই অসুন্তষ্টিতে আইন কতটা সমান অধিকার দিতে পেরেছে বা পারে। মোদ্দা কথা ফেয়ার ট্রায়াল নামে যে ধারনাটুকু রয়েছে সেটির প্রতিফলন কতটুকু রয়েছে এই পুরো বিচারিক প্রক্রিয়ায় এটাই আসলে এই অংশে মূল বিবেচ্য।

আন্তর্জাতিক অপরাধের ক্ষেত্রে বিচারকেন্দ্রিক মূল আইনী কাঠামো, কন্টেন্ট বিবেচনা ও এই মামলায় তার প্রয়োগ

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তথা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ক্ষেত্রে একটি অপরাধকে সঠিকভাবে প্রমাণ করবার মূল ভিত্তিগুলো কি, সে ব্যাপার গুলো এই অংশে সংক্ষিপ্ত ভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। এই আলোচনার প্রেক্ষিতে মূলত আমাদের এটাও দেখতে হবে যে বাংলাদেশের এই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের ক্ষেত্রে আদালত ঠিক কোন এপ্রোচ অনুসরন করেছেন তথা তাঁদের সিদ্ধান্ত নেবার প্যাটার্নটি আসলে কেমন বা সেটি কি।

সাবজেকটিভ [ আইনত দন্ডনীয় অপরাধমূলক কাজটি সংগঠিত করা] এলিমেন্ট এবং অবজেকটিভ [ ঐ অপরাধ সংগঠনের জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক উপাদান] এলিমেন্ট অফ আ ক্রাইমঃ

পৃথিবীর যে কোনো দেশেই একটি অপরাধ মামলা আদালতে নিষ্পত্তি ক্ষেত্রে ঐ অপরাধ কেন্দ্রিক দুইটি জিনিস বিবেচিত হয়। প্রথমত একটি কাজ [Act] যেটা আইনত নিষিদ্ধ কিংবা অমিশন [omission, যদি অভিযুক্তের সাথে ভিকটিমের প্রি এক্সিস্টিং আইনী লায়াবিলিটি থেকে থাকে,যেমন একজন চিকিৎসকের সাথে তার রোগীর সম্পর্ক, আগের থেকেই ভিক্টিমের সাথে পরিচিত, আত্নীয় ইত্যাদি] এবং এই কাজ করতে গিয়ে তার মেন্টাল এলিমেন্ট কিংবা ওই কাজ করবার তার যে ইচ্ছা সেটি। যাকে [Mens reus] “মেন্স রিয়া” বলে অভিহিত করা যায়। ল্যাটিন ভাষায় একটি কথা আছে সেটি হচ্ছে-  actus reus non facit reum nisi mens sit rea, which means "the act is not culpable unless the mind is guilty".  

যদিও আবার এই “মেন্স রিয়া” আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ক্ষেত্রে একটু ভিন্নভাবে দেখা হয়। এখানে মেন্টাল স্টেটগুলোতে বিবেচনা করা হয় ঘটনার সারকমাস্টেন্স, কন্সিকোয়েন্সেস এবং এই উক্ত দুইটি ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি অপরাধের জন্য আলাদা আলাদা মেন্স রিয়ার এনালাইসিস বিবেচ্য হয় একদম স্বকীয় ভাবে। আবার এমনও হতে পারে যে একটি অপরাধের ক্ষেত্রে একাধিক মেন্টাল এলিমেন্ট সামনে এসে যেতে পারে এবং সে কারনেই ICC সংবিধিতে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে এর অনুচ্ছেদ ৩০-এ “মেন্টাল এনালাইসিস এপ্রোচ” এর কথা বলা রয়েছে। সংবিধি ৩০ শে বলা হচ্ছে যে-

Article 30: Mental element

 1. Unless otherwise provided, a person shall be criminally responsible and liable for punishment for a crime within the jurisdiction of the Court only if the material elements are committed with intent and knowledge.

 2. For the purposes of this article, a person has intent where:

 (a) In relation to conduct, that person means to engage in the conduct;

(b) In relation to a consequence, that person means to cause that consequence or is aware that it will occur in the ordinary course of events.

 3. For the purposes of this article, ‘knowledge’ means awareness that a circumstance exists or a consequence will occur in the ordinary course of events. ‘Know’ and ‘knowingly’ shall be construed accordingly.

 মেন্স রিয়ার প্রমাণের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে volitional & Cognative এই দুইটি ধারনাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে একটি আরেকটির সাথে পরিপূরক হিসেবে দেখা হয়। যেমন ভলিশনাল উপকরনটির ক্ষেত্রে দেখা হয় অপরাধের ইচ্ছা এবং সেটির লক্ষ্যে পৌঁছাবার বাসনা এবং কোগ্নেটিভ উপকরনের ক্ষেত্রে দেখা হয় যে পদ্ধতিতে অভিযুক্ত তার ইচ্ছা কিংবা বাসনা চরিতার্থ করতে চাচ্ছে সেটির ক্ষেত্রে তার জ্ঞান কতটুকু। এই দুইটি উপাদান একত্রে না দেখা হলে আসলে এই মেন্টাল এলিমেন্টকে প্রমাণ করা দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। 

 যদিও ICTY, ICTR ট্রায়াল গুলোর ক্ষেত্রে Offence Approach প্রিন্সিপাল প্রয়োগ করা হয়েছে যেখানে একটি অপরাধের ক্ষেত্রে মানসিক উপাদানগুলোকে প্রতিটি উপাদানের জন্য আলাদা আলাদা বিবেচনা না করে জেনারেল টার্মে সঙ্গায়িত করা হয়েছে। যেমন ইন্টেন্ট, রেক্লেসনেস, নেগলিজেন্স, স্পেশাল ইন্টেন্ট কিংবা দুটো একসাথে বা সবগুলো একসাথে বা তিনটি একসাথে।

 উপরের এই আলোচনার প্রেক্ষিতে এখন আমাদের দেখতে হবে যে আলোচ্য দুই অভিযুক্তকে যে অপরাধে অভিযুক্ত করেছে সেগুলো মূলত International Crimes [Tribunals] Act-1973 এর কোন অপরাধের ভেতর পড়ছে কিংবা বিজ্ঞ প্রসিকিউটর আইনের কোন সুনির্দিষ্ট ধারায় এই দুই অভিযুক্তের অভিযোগগুলোকে বিন্যাস্ত করেছেন। Chief Prosecutor v Ashrafuzzaman Khan & Chowdhury Mueen Uddin  মামলার রায়ের ২০ নং পরিচ্ছদে আমরা দেখতে পাই যে এই সুনির্দিষ্ট আইনী ধারা গুলো হচ্ছে ঐ উক্ত আইনের Section 3(2) (a) (b)(g)(h) ধারায়। যার মানে গিয়ে দাঁড়ায় যে ঐ দুই অপরাধীর বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ গুলোর আইনী ধারা পড়েছে-

 a) Crimes against Huminity

b) Crimes Against Peace

g) Attempt, abetment or conspiracy to commit any such crimes

h) Complicity in or failure to prevent commission of any such crimes

 এই উপরে বর্ণিত অপরাধের বিস্তারিত একটু দেখে নেওয়া যাক-

 (a) Crimes against Humanity: namely, murder, extermination,enslavement, deportation, imprisonment, abduction, confinement,torture, rape or other inhumane acts committed against any civilian population or persecutions on political, racial, ethnic or religious grounds, whether or not in violation of the domestic law of the country where perpetrated;

 (b) Crimes against Peace: namely, planning, preparation, initiation or waging of a war of aggression or a war in violation of international treaties, agreements or assurances;

              (g) Attempt, abetment or conspiracy to commit any such crimes;

 (h) Complicity in or failure to prevent commission of any such crimes.

 ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ ইয়াগোস্লোভাকিয়া  [ICTY]-এর মধ্যেই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের এই ধারনাকে বেশ বৃহৎ পরিসরে বিশ্লেষিত ও সংজ্ঞায়িত করা হয়। এই আদালতের সংবিধির ৫ নাম্বার অনুচ্ছেদে উক্ত অপরাধ হতে হলে কি কি উপাদান লাগবে তার একটা ধারনা ঐ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আদালত ৫ টি উপাদানের কথা বলেন যেগুলো হলো-

            1. The existence of an overarching attack

           2.  the perpetrator’s conduct must be part of the attack

             3. The attack must be directed against any civilian population

             4.the attack must be widespread and systematic

             5.The perpetrator must know of the wider context in which his conduct occurs and as a result must  be aware    that his conduct constitutes part of the attack.

উপরে আলোচ্য এই রকম একটা আইনী অবস্থান ও প্রয়োজনীয় উপাদানের প্রেক্ষিতে আলোচ্য মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের মামলায় ট্রাইবুনাল-২ আদালত রায়ের ৫৯ নাম্বার পরিচ্ছদে কিছু স্পস্ট দিক নির্দেশনা দেন। যেখানে আদালত বলেন-

59. In resolving the issue of culpability of the accused persons with the commission of offence alleged the relevant facts, considering the nature and pattern of crimes alleged, need to be adjudicated are (i) Which organisation or group was involved in perpetration of the crimes alleged

(ii) had the accused persons affiliation with the perpetrator group or organisation? If it is so, in what capacity? (iii) Was the mission of killing executed in furtherance of ‘common plan and design’? (iv) Were the accused persons part of such common plan and design? (v) Mode of participation of the accused in accomplishing the planned crimes (vi) Was the killing of intellectuals an outcome of planned and calculated large scale killing?

 তার মানে দাঁড়াচ্ছে আদালত এই মামলার ক্ষেত্রে প্রথমেই নির্ধারণ করতে চেয়েছে [১] যে দল বা সংগঠন এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে সেটিকে, [২] তারপর আদালত দেখতে চেয়েছে এই সংগঠনের সাথে অভিযুক্তি ব্যাক্তি কতটুকু জড়িত ছিলেন কিংবা আদৌ ছিলেন কিনা,[৩] এই হত্যাকান্ডের পুরো মিশনটি একটি কমন প্ল্যান ও ডিজাইনের অংশ হিসেবে ছিলো কিনা [৪] ঐ অভিযুক্তরা এই কমন প্ল্যান ও ডিজাইন অংশের সাথে জড়িত ছিলো কি না [৫] জড়িত থেকে থাকলে এই পরিকল্পিত ও সু বিন্যাস্ত কার্য সমাধা করবার পুরো প্রক্রিয়াটা কি ছিলো [৬] বুদ্ধিজীবিদের হত্যাকান্ড কি পূর্ব পরিকল্পিত লার্জ স্কেলে যে হত্যাকান্ডের ম্যাপ সেটারই ফলাফল?

 আদালত এই মামলার ক্ষেত্রে এভাবেই সাবজেকটিভ ও অবজেকটিভ এলিমেন্টগুলোকে বিন্যাস্ত করে সেগুলোর উত্তর খুঁজতে কিংবা প্রমাণ পেতে চেয়েছেন অভিযোগকারী প্রদত্ত সকল সাক্ষ্য, তথ্য, উপাত্ত সাপেক্ষে কিংবা বিবাদীর প্রদত্ত পালটা যুক্তি ও প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে আদালত প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের প্রয়াস পেয়েছেন। এই প্রদত্ত রায়ের ৩৭৭ থেকে ৩৮৮ এবং ৪০৪ থেকে ৪০৭ পরিচ্ছদেও এই উপরের আলোচ্য এলিমেন্টগুলোর ব্যাপারে ব্যাপারে একটা দিক নির্দেশনা দেন। আদালত বলেন-

 377. The offence of crimes against humanity is a system crime and committed by collectivity of criminal acts of group of perpetrators and persons concerned with the commission of crimes. On adjudication of the events under charge nos. 6 and 7 we have already found the accused persons guilty for the offence of ‘extermination’ as crimes against humanity as they were concerned with the common plan and design and also participated to the commission of the offences.

 378. The Tribunal notes that to incur criminal liability, in a case of crimes against humanity, the accused himself need not have participated in all aspects of the alleged criminal conduct. [ Stakic, ICTY Trial Chamber, July 31, 2003, para. 439]. The actus reus of aiding and abetting a crime may occur before, during, or after the principal crime has been perpetrated [Blaskic, ICTY Appeals Chamber, July 29, 2004, para. 48]. Participation may occur before, during or after the act is committed.

 404. The case in hand concerns the killing of intellectuals, a large scale killing targeting selected individuals of a particular group, just at the fag end of war of liberation. It has already been proved that the ‘annihilation operation’ was in furtherance of organised and calculated plan and design aiming to liquidate the illustrious sons and daughters of the soil with intent to cripple the Bengali nation. All the events of murdering selected intellectuals were part of such notorious plan and accomplished in systematic manner.

405. Therefore the crimes for which the accused persons have been found guilty were not isolated crimes. Those were part of ‘systematic’ and ‘planned’ ‘attack’ intended to the accomplishment of offence of ‘large scale killing’ constituting the offence of ‘extermination' as crimes against humanity enumerated in section 3(2) of the Act, in furtherance of designed policy and plan. The criminal acts forming part of attack were directed against civilian population belonging to a particular class, within a context. The context element is the æinternational element” in crimes against humanity which renders certain criminal conduct a matter of international concern. Thus, the rationale of the ‘context’ element can be summarized as the protection of human rights against the most serious and most dangerous violations.

406. The notion of ‘attack’ thus embodies the notion of acting purposefully to the detriment of the interest or well being of a civilian population and the ‘population’ need not be the entire population of a state, city, or town or village. Thus, a single act of an accused forming part of attack committed against even a single unarmed civilian causing criminal act constituting the offence enumerated in the Act of 1973 is sufficient for holding him criminally responsible.

407. The phrase ‘acts committed against any civilian population’ as occurred in section 3(2)(a) clearly signifies that the acts forming attack must be directed against the target population to the accomplishment of the crimes against humanity and the accused need only know his acts are part thereof. In the case in our hand, the facts and circumstances unveiled before us unmistakably have proved the ‘contextual requirement’ to qualify the criminal acts done by the accused persons as the crimes against humanity.

আদালত দুই অভিযুক্তের অবস্থান, অপরাধের সাথে তাদের সংযুক্ততা, অপরাধের ধরন এবং সে প্রেক্ষিতে তাদের রেস্পন্সিবিলিটি নির্ণয়ে একটা অবজার্ভেশনও দেন তাঁদের রায়ের ৪৩৮ নাম্বার পরিচ্ছদে যেখানে আদালত বলেন-

438. In the case in hand, considering the charges proved and facts relevant thereto we take some factors into account as the key requirement of aggravating circumstances for the purpose of sentence to be imposed and these are (i) the position or leadership of the accused persons on Al-Badar (ii) the accused persons’ role and mode of participation (iii) culpable affiliation with the AB HQ and activities carried out there (iii) the extreme violent, and humiliating nature of the acts done in accomplishing the murders.

 আন্তর্জাতিক আদালতে, আন্তর্জাতিক অপরাধের ক্ষেত্রে এই ধরনের অপরাধের বিচার করবার যে পদ্ধতি এবং যে গাইড লাইন তৈরী হয়েছে এত বছরের পর বছর, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত-২ এর ব্যখ্যায় সেটিরই একটা সুস্পস্ট প্রতিফলন দেখা গেলো আলোচ্য মামলার ক্ষেত্রে। এইসব বিচারিক ক্ষেত্রে যে কনসেপ্ট গুলো এতদিনে বেশ জেঁকে বসেছে এবং অনুসরণীয় হয়ে এসেছে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এই ধরনের আদালতগুলোর সংবিধিতে সেগুলোর সাথে আমাদের আদালতের ব্যাখ্যা করলে যেটা দেখা যায় সেটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এডপ্টেড এই জাতীয় মামলার ধারনাগুলোর একটি মৌলিক ব্যাখ্যা যেটি এই রায়কে অত্যন্তভাবে জাস্টিফাইড করেছে।

 সাক্ষ্য, তথ্য-উপাত্ত  বিবেচনা

এই মামলার প্রায় শুরুর দিকে সাক্ষ্য সম্পর্কে আদালত কিছু মতামত ব্যাক্ত করেন। আদালত বলেন-

60. In prosecuting internationally recognised crimes involving mass atrocities availability and collecting evidence is a key challenge indeed. Instantly after the post conflict situation evidences are usually disordered and disintegrated in many different ways. The individuals engaged in committing mass atrocities very often destroy evidence of their culpability. Naturally they, by operating secrecy, attempt to minimize the existence of evidence, documents and other traces of their incriminating acts. Despite this reality there may  be potentially relevant documentary evidence such as contemporaneous domestic and international news accounts, authoritative films and photographs. This nature of old evidence is admissible under the Act of 1973 and the Tribunal shall have discretion to weigh the probative value of this documentary evidence together with material relevant facts.

এই মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য বিবেচনা করতে গিয়ে আসলে তেমন কিছুই বলার নেই। প্রসিকিউশনের আগত ২৫ জন সাক্ষী যাদের মধ্যে অবশ্য দুইজন সাক্ষী রয়েছেন যারা এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁদের ব্যাতিরেকে এই মামলায় আমরা অনেক চাক্ষুস সাক্ষী দেখতে পাই যারা সরাসরি এই দুই অভিযুক্তকে অপরাধের সময় সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছেন কিংবা কোনো সাক্ষী নিজেই টর্চার সেলে থেকে এদের ঘৃণ্য কর্মকান্ডকে প্রত্যক্ষ করেছেন। আদালতের এই রায়ের বিভিন্ন অংশেই আমরা সেসব ঘটনাগুলোর বর্ণনা পাই। আদালতের রায়ের ১৯৯ এবং ২০৫ নাম্বার পরিচ্ছদে দেখতে পাই-

199. P.W.11 Iftekhar Haider Chowdhury, nephew of martyred Professor Mofazzal Haider chowdhury, was eight years old in 1971.According to him Professor Mofazzal Haider himself had identified accused Chowdhury Mueen Uddin, who was his student. The witness said he along with his parents and other family members were present when Al-Badar men forcibly took away the Professor on December 14, 1971.

 চৌধুরী মইনুদ্দিনের পরে থাকা মুখোশ টান দিলেই বের হয়ে ওঠে আসল সত্য-

 205. P.W.11 went on to state that as Mofazzal was getting ready, Lutful [father of P.W.11] engaged in a conversation with an Al-Badar man, whose face was covered by a handkerchief. At one stage of the conversation, Lutful [father of P.W.11] removed the handkerchief. His uncle [Mofazzal] looked at that man and said “aren’t you Mueen Uddin?” The man replied, ‘yes, I am Mueen Uddin, I am your student’. He [P.W.11] himself heard this brief conversation standing beside his uncle and his father, P.W.11 added. Later Al-Badar men took away his uncle in a microbus

 চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের এই আল-বদর টর্চার সেল থেকে বের হয়ে আসা একজন সৌভাগ্যবান ব্যাক্তি দেলোয়ার হোসেন। তিনি আদালতে বলেন-

206. P.W.22 Delwar Hossain the lone survivor from the clutch of AB had occasion to witness the activities carried out by the AB at the torture center set up at Mohammadpur Physical College. He in an interview made to UK based channel-4 narrates [in a documentary film titled ‘war crimes file’] how Professor Mofazzal Haider Chowdhury was subjected to inhuman torture at the torture center. He [P.W.22] narrates in his interview—“Even in the darkness…..I was able to recognise him. He was being interrogated. He said his name was Mofazzal Haider Chowdhury.Right after that, they started beating him. They used an iron rod. They kept beating him all over his eyes, his face, his hands. He screamed as he was being tortured.” Delwar Hossain while testifying as P.W.22 also described what he experienced and how he could recognise the detained Professor Mofazzal Haider Chowdhury at the AB torture camp, during his confinement there.

আদালত এই চাক্ষুস সাক্ষীর ব্যাপারে বলেন-

 330. We have found from evidence of P.W.22 Delwar Hossain, an eye witness who was kept confined at the AB HQ’s torture camp on 14 December 1971 that the notorious Al-Badar men started beating Muneir Chowdhury and Mofazzal Haider Chowdhury indiscriminately by iron rod When Professor Mofazzal Haider Chowdhury on asking replied that he authored books on Rabindranath Tagore.

 এছাড়াও আদালতের রায়ের ৩৮৩ অনুচ্ছেদে আমরা জানতে পারি সাক্ষী মফিজের কথা যিনি ১৯৭১ সালে চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের মাইক্রোবাসের চালক ছিলেন এবং যেই মাইক্রোবাসে করে ভিকটিমদের এই দুই অভিযুক্ত ধরে নিয়ে যেতো। সাক্ষী মফিজ নিজের চোখে দেখেছেন কি করে চোখ বেঁধে দাঁড় করিয়ে বুদ্ধিজীবিদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছিলো সে সময়।

 সাক্ষী দেলোয়ার হোসেনের প্রদত্ত আরেকটি তথ্য এই মামলার প্রদত্ত রায়ের ৩১৪ পরিচ্ছদ থেকে জানা যায় যে সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের কথা।

 314. P.W.22 stated that he saw the killing as his blindfold was loose. At one point, he [P.W.22] heard screams of a woman, who was requesting to release her by saying “don’t kill me. You have mothers and sisters. What would you do if I were your mother or sister? I have a little kid; he will die, if you kill me.”Asked by the killers, the woman identified her as journalist Selina Parveen.

 এই বেঁচে থাকবার আকুতির পরেও খুনীদের মন গলেনি। নৃশংসভাবে হত্যা করেছে শিলালিপির সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে। আদালত এই রায়ের ৩১৬ পরিচ্ছদে তাঁর বিষ্ময় এবং অবজার্ভেশন প্রকাশ করেন এভাবেই-

 316. Selina Parveen begged her life, appealed to spare her as she had a kid and there was none to take care of him [P.W.3] excepting her. But the brutal killers did not spare her. She was instantly killed by charging bayonet, as narrated by P.W.22. What an impious butchery! What a Sacrilegious butchery! What a shame for human civilization! Selina Parveen was a mother. The appalling attack was done not only to Selina Parveen but to the mother’s line. The killing was rather a ‘matricide’. This indescribable brutality shocks the human conscience indeed.

 আদালত তার রায়ের ২৩৭ নাম্বার পরিচ্ছদে কিছু গুরুত্ব্বপূর্ণ তথ্য দেন। চৌধুরী মইনুদ্দিন এবং আশরাফুজ্জামান যে জামাতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংস্থার মাধ্যমে গঠিত হওয়া আলবদর বাহিনীর সদস্য সেটির উপর একটা সিদ্ধান্ত মূলক পরিচ্ছদই হচ্ছে ২৩৭ নাম্বার পরিচ্ছদ। যেখানে বিধৃত হয়েছে যে আদালত কোন কোন এভিডেন্সের প্রেক্ষাপটে এসব সিদ্ধান্তে এসেছেন। সে অনুযায়ী এই পরিচ্ছদে সেসব প্রমাণাদির একটা লিস্টও দেয়া হয়।

 উপরে সব মিলিয়ে আমি কিছু সাক্ষীর অংশ বিশেষের বর্ণনা কিংবা আদালতের কিছু অবজার্ভেশন উদাহরন হিসেবে বর্ণনা করেছি। এই মামলার ক্ষেত্রে আদালত যে আইনী কাঠামো ধরে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, এটা বলা বাহুল্য যে সে কাঠামোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ক্ষেত্রে এইসব সাক্ষ্য, প্রমাণ, তথ্যই আসলে মূল উপজীব্য। আমাদের দেশে প্রচলিত যে সাক্ষ্য আইন রয়েছে সেটি এই ট্রাইবুনালের ক্ষেত্রে প্রোযজ্য নয়। ফৌজদারী কার্যক্রমে যে দীর্ঘসূত্রিতা রয়েছে সেগুলোর পেছনে বাংলাদেশের এই সাক্ষ্য আইনের নানাবিধ জটিলতা অনেক অংশে দায়ী বলেই এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ফৌজদারী কার্যবিধি কিংবা এর অনুরূপে এই ট্রাইবুনাল পরিচালিত হলে ট্রাইবুনাল আসলে একটি ব্যার্থতায় পর্যবাসিত হোতো। এটিও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের অন্তর্ভূক্ত যে কোনো মামলার ক্ষেত্রেই সাক্ষ্য আইন সাধারণত ওই দেশের প্রচলিত আইনের থেকে ব্যাতিক্রম হয়। এর বড় কারন হচ্ছে অপরাধের ক্ষেত্র আর ধরন। সাধারন অপরাধের বেলায় যেভাবে তথ্য কিংবা সাক্ষ্য ধারন করা সম্ভবপর হয় সেটি এই ধরনের যুদ্ধ-বিগ্রহ কালে অনেকটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এর চাইতে বড় ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই বিচার শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ঠিক ৩৯ বছর পর। সুতরাং সময়, কাল, এত সময় পর্যন্ত ব্যাক্তির স্মৃতি, সাক্ষ্য দেবার ক্ষমতা সব কিছুকেই বিবেচনা করে এই আদালতের সাক্ষ্য আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছিলো। উপরের বর্ণনা পরে একটা ধারনা পাওয়া যায় যে আদালত এই মামলার ক্ষেত্রে তাঁদের সিদ্ধান্ত দেবার আগে কিভাবে সাক্ষ্য কিংবা অভিযোগের প্রেক্ষিতে তথ্য-প্রমাণ ইত্যাদিকে বিশ্লেষন করেছেন।

 অভিযোগকারী ও অভিযুক্তের পক্ষে যুক্তিগুলো এবং আদালতের পক্ষ থেকে আইনী ব্যাখ্যার সারমর্ম

প্রসিকিউশনের পক্ষে থেকে এরই মধ্যে উত্থাপিত অভিযোগ গুলো এই লেখার শুরুতেই বলা হয়েছে। প্রসিকিউটির শাহিদুর রহমান যে অভিযোগগুলো অভিযুক্তের পক্ষে এনেছেন সেগুলোর সেগুলোর সম্পর্কে একটা জানা যায় আদালতের ২৮,২৯ নাম্বার পরিচ্ছদ এবং পরবর্তীতে বিবাদী পক্ষের পালটা যুক্তির প্রেক্ষিতে তাঁর যুক্তিতে। যেটি রয়েছে ৩৩ ও ৩৪ নাম্বার অনুচ্ছেদে। অপরদিকে বিবাদী পক্ষের আইনজীবিদ্বয় জনাব আব্দুস শুক্কুর খান ও জনাবা সালমা হাই টুনি তাদের মক্কেলের পক্ষে যে যুক্তি তুলে ধরেন সেটি সম্পর্কে আমরা জানতে পারি এই মামলার রায়ের ৩০,৩১,৩২,৩৫,৩৬,৩৭,৩৮ নাম্বার পরিচ্ছদে।

রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবি জনাব শাহিদুর রহমান মূলত আনীত অভিযোগের প্রেক্ষিতে আইনের ধারা এবং সেগুলোর আলোকে যেসব অপরাধ অভিযুক্তরা করেছেন সেটির সাথে আইনের স্পেসিফিক উপাদানগুলোর যোগসূত্র করেন এবং সে অনুযায়ী তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি চান। তিনি চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের কর্মকান্ডকে একটি পূর্ব পরিকল্পিত প্ল্যানের অংশ হিসেবে একই পদ্ধতিতে ১৮ জন বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করেন বলে তিনি তার বক্তব্য দেন ও তথ্য প্রমান উপস্থাপন করেন। এই হত্যাকান্ড ছিলো একটি সিস্টেমিটিক ও ওয়াইডস্প্রেড হত্যাকান্ড, এই হত্যাকান্ডের কনসিকোয়েন্স সম্পর্কে হত্যাকারীদের স্বচ্ছ ধারনা ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করে তিনি মানবতা বিরোধী অপরাধ ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণকল্পে যে সাব্জেক্টিভ ও অবজেক্টিভ এলিমেন্ট রয়েছে সেটির সাথে একটি যোগসূত্র করে আদালতে তাঁর সাবমিশান দেন।

অপরদিকে বিবাদী পক্ষ এই তাদের মক্কেলের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগকে নাকচ করে দেন। এই নাকচ করে দিতে গিয়ে তারা বলেন যে অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে আগেই অভিযোগ এসেছে এবং সে সময় তাদের বিরুদ্ধে তদন্তও হয়েছে [অভিযুক্ত মইনুদ্দিনের বিরুদ্ধে ১৯৯৭ সালে একটি মামলা হয়েছিলো এবং সেই মামলার ক্ষেত্রে কেবল একটি তদন্তও হয়েছিলো] তাদের মক্কেলরা দোষী হয়ে থাকলে দালাল আইন ১৯৭২-এ ই বিচার হতে পারত কিংবা ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের যেখানে ছেড়ে দেয়া হয়েছে এবং তাদের সাধারন ক্ষমা ঘোষনা করা হয়েছে এবং তারা আরো বলছেন যে এই আলোচ্য আদালতের আইন করাই হয়েছে উক্ত ১৯৫ জন আসামীর বিচার করার জন্য সুতরাং এই আইনে তাদের আর বিচার চলতে পারেনা।

বিবাদী পক্ষের এসব যুক্তি’র প্রেক্ষিতে আদালত তার একটি অবজার্ভেশন দেন। আমি এই অবজার্ভেশনের চুম্বক অংশ হুবুহু ইংরেজীতে তুলে দিচ্ছি রায় থেকে। আমার মনে হয় এই সহজবোধ্য ব্যখ্যাটির আর বাংলা অনুবাদ করবার দরকার নেই,সে কারনেই আর এই অংশটির বাংলা সারমর্ম করছি না। আদালত তার প্রদত্ত রায়ের ৩৯ থেকে ৫৭ পরিচ্ছদে এই বিষয়ে আদালত তার দীর্ঘ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আদালত বলেন-

মুক্তিযুদ্ধের এতদিন পর এই বিচারের বৈধতা নিয়ে তথা এই যে অপরাধের কথা বলা হয়েছে তা তামাদি হয়ে গেছে কিংবা তার বিচারের যৌক্তিকতা নিয়ে চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের আইনজীবিদের যুক্তি এবং তার প্রেক্ষিতে আদালতের উত্তর।

39. We have already settled this issue by recording our finding in earlier cases that mere delay does not create any clog in bringing criminal prosecution. But the defence argued that unexplained inordinate delay of long 40 years occurred in prosecuting the accused impairs the truthfulness of the case and it reflects political motive too.

 40. It is to be noted that neither the Genocide Convention of 1948, nor the Geneva Conventions of 1949 contain any provisions on statutory limitations to war crimes and crimes against humanity. Criminal prosecutions are always open and not barred by time limitation. We reiterate that there can be no recognised hypothesis to insist that such a ‘system crime’ can only be pursued within a given number of years. Therefore, delayed prosecution does not rest as a clog in prosecuting and trying the accused and creates no mystification about the atrocities committed in 1971. Considerations of material justice for the victims should prevail when prosecuting crimes of the severe enormity is on the process.

১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা প্রসঙ্গে বিবাদী পক্ষের আইনজীবিদের যুক্তি এবং তার প্রেক্ষিতে আদালতের ব্যাখ্যাঃ

 45. A closer look at the repatriation process of 195 Pakistani War Criminals [tripartite agreement] suggests that the political direction of the day had to put on hold the trial process at that time, but intended not to terminate the option of any future trial. The Tripartite Agreement visibly mentioned Bangladesh’s position on the 195 Pakistani War Criminals in the Article 13 of the agreement which is as below: “There was universal consensus that persons charged with such crimes as 195 Pakistani prisoners of war should be held to account and subjected to the due process of law”.

 46. However, the Article 15 of the tripartite agreement says: “Having regard to the appeal of the Prime Minister of Pakistan to the people of Bangladesh to forgive and forget the mistakes of the past” Government of Bangladesh had decided not to proceed with the trials as an act of clemency.

 47. Thus, the scope of clemency is evidently limited to Bangladesh’s decision on not to try them here. Rather, it keeps the option open for trial of those Pakistani war criminals.

 48. Additionally, such agreement was an ‘executive act’ and it cannot create any clog to prosecute member of ‘auxiliary force’ or an ‘individual’ or member of ‘group of individuals’ as the agreement showing forgiveness or immunity to the persons committing offences in breach of customary international law was disparaging to the existing law i.e the Act of 1973 enacted to prosecute those offences.

 “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইন করা হয়েছিলো কেবল মাত্র পাকিস্তানী ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য। সুতরাং অভিযুক্তদের এই আইনে বিচার করা যাবে না” বিবাদী পক্ষের এই যুক্তির প্রেক্ষিতে আদালতের ব্যাখ্যাঃ

53. Defence avers that the cumulative effect of intention of enacting the Act of 1973 was to prosecute and try the 195 war criminals belonging to Pakistani army and its auxiliary force. The individuals who collaborated with the army could have been prosecuted and tried under the Collaborators Order 1972.  

54. The Tribunal notes that the phrase ‘individual’ or ‘group of individuals’ as appeared in the Act of 1973 inevitably shows that bringing prosecution against the accused under the Act of 1973 permissible. Mere non-prosecuting the accused persons under the Collaborators Order 1972 for their horrendous criminal activities does not rest any barrier to present prosecution under the Act of 1973, a different legislation meant to prosecute and try the internationally recognized offences committed in violation of customary international law.

 55. We reiterate that the Collaborators Order 1972 was a piece legislation aiming to prosecute and try the persons responsible for the offences enumerated in the schedule thereof. The offences punishable under the Penal Code were scheduled in the Collaborators Order 1972. While the Act of 1973 was enacted to prosecute and try the ‘crimes against humanity’, ‘genocide’ and other ‘system crimes’ which are recognised as international crimes committed in violation of customary international law. There is no scope to characterize the offences underlying in the Collaborators Order 1972 to be the ‘same offences’ as specified in the Act of 1973.

 বিবাদী পক্ষ কর্তৃক ডাবল জিওপার্ডি [একই অপরাধে দুইবার বিচার] এবং ব্যাড ল ইস্যু উত্থাপন ও তার ব্যাখ্যাঃ

 56. The learned state defence counsel drawing attention to the fact of initiating a case few years back, in 1997 by lodging First Information Report [FIR] with Ramna Police Station, DMP by Farida Banu [P.W.16] under the Penal Law for the charge of killing Professor Gias Uddin, a victim intellectual [charge no.6] submitted that the same ended in submission of Final Report as mistake of law on 2.8.2002 and thus now the accused cannot be prosecuted again.

 57. We disagree with the above submission. The accused person [Chowdhury Mueen Uddin] has been prosecuted not for an offence punishable under the Penal Code. He has been brought to justice for the charge of committing the offences enumerated in the Act of 1973 and not for the ‘same offence’. Besides, the said case was merely lodged and ended in submission of Final Report and not after trial. On this score as well the doctrine of ‘double jeopardy’ does not come into play at all.

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালঃ পার্সেপশন অফ ফেয়ারনেস, “কনসেপ্ট অফ ফেয়ার ট্রায়াল” এবং সেই প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের অবস্থান

চলমান এই ট্রাইবুনালের সাথে একটা স্পেসিফিক ধারনা জুড়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে ট্রাইবুনাল শুরু হবার অনেক আগ থেকেই। এই ধারনার নাম হচ্ছে “ফেয়ার ট্রায়াল” হচ্ছে না। এটা ট্রাইবুনাল বিরোধীদের ক্যাম্পেইনের ট্যাগ লাইন ছিলো এবং আছে। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিটা মূলত হোম ওয়ার্ক করে রাখতে চেয়েছে ট্রাইবুনাল শুরুরও অনেক আগে। তারা পৃথিবীর সব বড় বড় পি আর ফার্ম গুলোকে নিযুক্ত করেছে, সব চাইতে বেস্ট আইনী ফার্ম গুলোর সাথে কথা বলে রেখেছে, একাডেমিক, রাজনীতিবিদ, বুরোক্রেট, শিক্ষক তথা সমাজের সব স্তরের সাথে একটা সমন্বয় করেছে। সেটা দেশী এবং বিদেশী দুই ভাবে প্রোযোজ্য। সেদিক থেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তুতি কিংবা ঐ একি ভাবে পাল্লা দেবার জন্য যে আগ্রহ সেটি একেবারেই ছিলো না বললেই চলে। এর একটা কারন অবশ্য আছে। বাংলাদেশ সরকার যেই পার্টিকুলার ধারনার বশবর্তী হয়ে শুরুতে এবং আজ পর্যন্ত রয়েছে সেটি হচ্ছে আমাদের চলমান বিচার ব্যাবস্থার যে ধারা, ট্র্যাডিশন কিংবা যে চলিত প্রক্রিয়া রয়েছে সেটিতেই নির্ভর করেছে। এটা সরকারের একটা ইগোইস্টিক প্রবলেমও ছিলো এই ভেবে যে, যদি দেশে বছরে হাজার হাজার মামলার নিষ্পত্তি হতে পারে দেশীয় চলমান বিচার ব্যাবস্থায়, প্রসেস কিংবা প্রক্রিয়ার তবে এই ট্রাইবুনালও সেভাবে চলতে পারে। আর বিদেশী লবিইং, পি আর ফার্ম, লেখা লেখি এগুলো জবাব দেবার প্রয়োজন সরকার খুব একটা বোধ করে বলে মনে হয়না। খুব সম্ভবত দেশীয় ব্যাবস্থায় বিচার হবে আন্তর্জাতিক ভাবে রেকোগনাইজড অপরাধগুলোর, এই চিন্তার বা সিদ্ধান্তের বশবর্তী হয়েই। কিন্তু সরকার একটা ব্যাপার হয়ত বিবেচনায় আনলেও ট্রাইবুনালে সেটির প্রকাশ দেখাতে খুব একটা আগ্রহী হয়নি যে যাদের বিচার হচ্ছে এরা ৪২ বছর আগের তাদের নড়বড়ে অবস্থাটিকে ভেঙ্গে দেশের রাজনীতিতে কিছুটা হলেও স্থান করেছে এবং দেশের একটা অংশকে তারা ইতিহাসের ভুল পাঠ দিয়ে এই দেশেই লালন করে তুলেছে।

সুতরাং এদের একটা সুনির্দিষ্ট সমর্থক আছে, অর্থের ক্ষমতা আছে। এই ব্যাপারটা বিবেচনায় রাখতে পারত সরকার। তবে সরকার হয়ত সমর্থক, প্রভাবশালী, এসব বিষয় মাথায় না রেখে অভিযুক্তের বিচার হবে বা একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাবে আর ১০ জন অভিযুক্তের মতই এভাবেই ট্রিট করবার প্রয়াস পেয়েছেন। এটা ভালো কি মন্দ আমি সে তর্কে যাবোনা। সরকারের সমালোচনা কিংবা তারা কি করলে কি করতে পারত এটা নিয়ে আমার একটা নির্দিষ্ট ভাবনা আছে। আমি অন্য প্রবন্ধে এটি শেয়ার করব। ঐ যে শুরুতেই যে বলেছি যে এই স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিরা একটা ট্যাগ লাইন নিয়ে এগিয়েছে “ফেয়ার ট্রায়াল” হচ্ছে না। এই ট্যাগ লাইনের সাথে যারা যারা হাত তুলেছেন সেটির প্যাটার্ন আমি কয়েক ভাগে ভাগ করে ফেলতে পারি।

বিচার সম্পর্কে যারা ভাবছেন তাদের চিন্তার প্যাটার্ন এবং সেচিন্তা অনুযায়ী একটি তুলনামূলক প্রকার ভেদঃ

(১) একটা অংশ অন্ধভাবে বিশ্বাস করে যে এই বিচার ফেয়ার না। এদের আইন বা কানুন বুঝবার দরকার হয়না। এদের রাজনীতির প্রতি আস্থা নেই। এরা সরাসরি জামাত-শিবির কিংবা পাকিস্তানপন্থী বা উগ্র ইসলামী মৌলবাদী কেউ এদের রাজনীতির সমর্থক, কেউ অভিযুক্তের আত্নীয়, ছেলে, মেয়ে, স্বজন ইত্যাদি।

(২) একটা অংশ হচ্ছে যারা স্বাধীনতা বিরোধী না কিন্তু আওয়ামী রাজনীতি পছন্দ করেনা। যেমন বি এন পি, এল ডি পি। এরা মনে করে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকলে ফেয়ার ট্রায়াল হতে পারে না। আওয়ামীলীগ রাজনৈতিক একটা স্বার্থ হাসিলের চেষ্টায় রত। ১৯৯৬ সালে জামাতের সাথে লীগ আন্দোলন করেছে বলে একটা যুক্তি তুলে ধরে কিংবা ধরবার চেষ্টা করে। এই অংশ ফেয়ার ট্রায়াল মনে করেন না আওয়ামীলীগের সাথে আদর্শিক, ব্যাক্তিক, বৈষয়িক, রাজনৈতিক ইত্যাদির দ্বন্দে। এই দ্বন্দের একটা লুপ আছে যেটাতে এরা বার বার ফেরত আসে এবং সেটি উত্তীর্ণ হতে পারে না শত চেষ্টা করেও। এটাও আওয়ামীলীগের প্রতি আস্থাহীনতার কারনে।

(৩) একটা অংশ ফেয়ার ট্রায়াল মনে করেনা পিওরলি আইনের দৃষ্টিকোন থেকে নিজস্ব বিচার, বিবেচনায় ও খুব সুক্ষভাবে পরিমাপের পর। যদিও এতা তাদের ব্যাক্তিগত ধারনা মাত্র। তারপরেও এই অংশটিকে আমি ট্রাইবুনালের সত্যকারের সমালোচক মনে করি এবং এদের মধ্যেই সত্যকারের ফেয়ার ট্রায়াল হোক, এমন চাওয়ার মানুষ পাওয়া যায়।

(৪) একটা অংশ ফেয়ার ট্রায়াল মনে করেনা পুরোই অর্থনৈতিক স্বার্থের কারনে। এদের ফেয়ার ট্রায়াল মনে করা আর না করা নির্ভর করে অর্থের সংস্থান কোথা থেকে হচ্ছে। এরা মূলত বিদেশী লবি-ইস্ট, আইনজীবি ইত্যাদি। এই জাতীয় একটা অংশ দেশেও আছে।

সুতরাং পুরো প্যাটার্নটা লক্ষ্য করলে মূলত ৩ নাম্বার অংশটিকে প্রাধান্য দেয়া যেতে পারে এবং তাদের ধারনায় ভুল থাকলে কিংবা তাঁরা এই প্রক্রিয়াটিকে বুঝতে না পারলে সেটি নিয়ে আলোচনা চলতে পারে। সুতরাং ফেয়ার ট্রায়ালের ব্যাপারটি বলে কেউ নিজের ক্রেডিবিলিটির কোন অংশে আছেন সেটি হয়ত এখান থেকে যাচাই হতে পারে। অবশ্য এটা বলে নেয়া সমিচীন যে এই বক্তব্য সম্পূর্ণ আমার এবং আমার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই প্রসুত।

একটা ট্রাইবুনালের ফেয়ার ট্রায়াল কিংবা ইন্টারন্যশানাল স্ট্যান্ডার্ড বলতে আসলে কি বোঝায়? এটা কি বুঝে নেবার কিংবা ঘ্রাণ নেবার মত একটা ব্যাপার, কিংবা আমি মনে করে নিলাম, অমুক মনে করে নিলো, এমন কিছু? কিংবা আদৌ কি এই জাতীয় কোনো টার্ম একটা ধ্রুবকের মত কোথাও অবস্থান করে? এমন কোনো পরিমাপক কি আদৌ কোথাও রয়েছে যেখানে বলা হবে এই আইন মেনে চললে সেটি ফেয়ার, ঐ আইন মেনে চলে সেটি আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড? উত্তর হবে, না নেই।

একটা ফেয়ার ট্রায়াল হতে গেলে সেই ফেয়ার ট্রায়ালের সংজ্ঞা নিরূপন করা প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে আমি কোট করতি পারি Lawyers committee of Human Rights এর প্রকাশিত একটি প্রবন্ধকে। যেখানে ফেয়ার ট্রায়াল কি সেটি সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলা রয়েছে-

The right to a fair trial is a norm of international human rights law designed to protect individuals from the unlawful and arbitrary curtailment or deprivation of other basic rights and freedoms, the most prominent of which are the right to life and liberty of the person. It is guaranteed under Article 14 of the International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR),1 which provides that “everyone shall be entitled to a fair and public hearing by a competent, independent and impartial tribunal established by law.” The fundamental importance of this right is illustrated not only by the extensive body of interpretation it has generated but, most recently, by a proposal to include it in the nonderogable rights provided for in Article 4(2) of the ICCPR. 2 The right to a fair trial is applicable to both the determination of an individual's rights and duties in a suit at law and with respect to the determination of any criminal charge against him or her.

 সেখানে তারা তাদের প্রবন্ধে ফেয়ার ট্রায়াল হতে হলে কোন কোন সেক্টরে মূলত কি কি এপ্রোচ হতে হবে সেটির একটি আলোচনা তুলে ধরেন। আমি নীচে সেই ছোট ছোট অংশগুলোর শিরোনাম নীচে তুলে ধরছি

 A. PRE-TRIAL RIGHTS

1. The Prohibition on Arbitrary Arrest and Detention, 2. The Right to Know the Reasons for Arrest, 3. The Right to Legal Counsel, 4. The Right to a Prompt Appearance Before a Judge to Challenge the  Lawfulness of Arrest and Detention, 5. The Prohibition of Torture and the Right to Humane Conditions during, 6. The Prohibition on Incommunicado Detention, 

B. THE HEARING

1. Equal Access to, and Equality before, the Courts, 2. The Right to a Fair Hearing , 3. The Right to a Public Hearing , 4. The Right to a Competent, Independent and Impartial Tribunal, Established by Law , 5. The Right to a Presumption of Innocence , 6. The Right to Prompt Notice of the Nature and Cause of Criminal, 7. The Right to Adequate Time and Facilities for the Preparation of a, 8. The Right to a Trial without Undue Delay, 9. The Right to Defend Oneself in Person or through Legal Counsel, 10. The Right to Examine Witnesses, 11. The Right to an Interpreter, 12. The Prohibition on Self-incrimination, 13. The Prohibition on Retroactive Application of Criminal Laws, 14. The Prohibition on Double Jeopardy

 ফেয়ার ট্রায়াল মূলত নির্ভর করে অভিযুক্তের অধিকার কতটা রক্ষিত হচ্ছে, একটা ট্রাইবুনালের যে নিয়মগুলো রয়েছে সেটা কতটুকু পুংখানুপুংখ ভাবে রক্ষিত হচ্ছে, এমন কোনো নিয়ম রয়েছে কি না যেটিতে কারো অধিকার খর্ব হবার সম্ভাবনা বিরাজ করে সর্বৈব ভাবে সেটি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সর্বজনগ্রাহ্য যে মানবাধিকার চর্চা রয়েছে সেটির সাথে চলতে পারে। এখন এই উপাদানগুলো ভিন্ন ভিন্ন অবয়বে ভিন্ন ভিন্ন দেশের এই জাতীয় ট্রাইবুনালে বিরাজ করে। কেননা অনেক সময় এসকল উপাদান একটি আইনে থাকলেও সেটির প্রকাশ ভঙ্গি কিংবা ব্যাবহার সেই দেশের প্রচলিত প্রক্রিয়ায় হয়। এটাতে দোষের কিছু নেই বলেই মনে করা হয়। আরেকটু ঘুরিয়ে বলা যেতে পারে “কার্ডিনাল প্রিন্সিপাল ও ফেয়ার ট্রায়াল”, ন্যাচারাল জাস্টিস এগুলোর কথা যেগুলোর মূল সারমর্ম প্রিন্সিপাল হচ্ছে “ইকুয়ালিটি অফ আর্মস”।

এটার মানে হচ্ছে বাদী ও বিবাদী দুই পক্ষেরই সমান সুযোগ থাকতে হবে তাদের অধিকার রক্ষায়। এটা হতে পারে বিভিন্ন অর্গানে। তথ্য সংগ্রহ, সাক্ষী পরিচালনা সহ মামলার সকল ক্ষেত্রে। তারপরেও এতদিনের চর্চায় মূলত ফেয়ার ট্রায়াল হচ্ছে কি হচ্ছেনা, এই ব্যাপারটির সামান্যতম ধারনা পেতেও International Covenant on Civil and Political Rights,1966 (ICCPR) এর কিছু সুনির্দিষ্ট ধারাকে অনেকটা ধ্রুবকের মত ধরা হয়। এবার উপরে প্রদত্ত Lawyers Committee of HUman Rights প্রদত্ত যে ধারনা, উপকরণ গুলোর কথা বলা রয়েছে এবং সেখানে যে ICCPR এর মধ্যে থাকা অধিকার গুলো বা তার প্রকরণ গুলো নিয়ে বিস্তারিত বলা রয়েছে আসুন সেই ধ্রুবক বা উপকরণ গুলোর সাথে আমরা আমাদের আইনটিকে একটু মিলিয়ে দেখি। এটি আমাকে অবশ্যই বলতে হবে অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথে যে এই সুনির্দিষ্ট বিষয়টি এই বিচারিক ক্ষেত্রে প্রথমে তুলে ধরেন ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটর ও প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ তাঁর “Let there be light” প্রবন্ধে। আমি সে প্রবন্ধের ওই অংশটুকুরই অনুলিখন করছি এখানে-

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সাথে আমাদের ট্রাইবুনালের একটি তুলনামূলক উদাহরণ নীচে দেয়া হলোঃ 

১) এই আইনে অপরাধীকে দোষী প্রমাণের দায়ভার প্রসিকিউশনের যা বলা আছে ১৯৭৩ সালের আইনে ৬ নাম্বার চাপ্টার এর সাক্ষ্য অংশের ৫০ নাম্বার ধারায় । সুতরাং “the accused is presumed to be innocent until proven guilty” আইনের এই বিখ্যাত কথাটি সমুন্নত রয়েছে। সমগ্র আইনের কোথাও এই উক্তিটির বিরুদ্ধচারন করে কোনো ধারা নেই । এই কথা Article 14(2) of International Covenant on Civil and Political Rights,1966 (ICCPR) এও বলা আছে।

২)Article 14 of International Covenant on Civil and Political Rights,1966 (ICCPR)এ যে অধিকারগুলোর উল্লেখ রয়েছে তা ICTA-1973 এর ক্ষেত্রেও খুব সুন্দর ভাবে রয়েছে । আসুন দেখা যাক-

ক) ICCPR এর আর্টিকেল ১৪(১) এ বলা আছে ফেয়ার এবং পাব্লিক হিয়ারিং এর কথা যা কি না যোগ্য , স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ট্রাইবুনালের মাধ্যমে হতে হবে । ICTA-1973 এর ক্ষেত্রে, ধারা ৬(২ক) এর ক্ষেত্রেও যোগ্য, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন ট্রায়ালের কথা বলা হয়েছে । আবার ধারা ১০(৪) এ বলা রয়েছে , এই প্রসিডিংস হতে হবে পাবলিকলি এবং ট্রাইবুনাল যদি ঠিক মনে করে তবে ক্যামেরাও ব্যাবহার করা যেতে পারে ।

খ) ICCPR এর ১৪(৩) ধারায় বলা আছে যে, “Right to be informed promptly and in detail in a. language which he understands of the nature and cause of the charge against him” আবার এই কথা গুলোই বলা আছে ICTA-1973 এর ১০(১)(ক) , ১০(৩) এবং ১৬(২) ধারায়।

গ) ICCPR এর আর্টিকেল ১৪(৩)(খ) ধারায় বলা আছে যে , “Right to have adequate time and facilities for the preparation of his defence and to communicate with counsel of his own choosing . একনন আমরা যদি ICTA-1973 এর দিকে নিজর দেই, তাহলে দেখব যে, এই আইনের ১৭(২) ধারায় বলা আছে , “An accused person shall have the right to conduct his own defence before the Tribunal or have the assistance of counsel”

ঘ) ICCPR এর ১৪(৩)(গ) ধারায় বলা আছে যে, “Right to be tried without undue delay. ঠিক আমাদের আইন ICTA-1973 এর ১১(৩) এর (ক) ও (খ) ধারায় এই কথাগুলোই আরো ব্যখ্যা করে বলা আছে।

ঙ) ICCPR এর ১৪(৩)(ঘ) ধারায় বলা আছে , “Right of representation” এইদিকে আমাদের ICTA-1973 এর ১৭(২) ও ১২ ধারাতে স্পষ্ট করে এই কথাগুলো বলা আছে ।

চ) ICCPR এর ১৪(৩)(ঙ)ধারায় বলা আছে, “Right to produce and examine/cross examine witness”. ঠিক আমাদের ICTA-1973 এর ১০(ঙ) ধারা , ১০(চ),১০(ছ) এবং ১৭(৩) ধারাতে ঠিক ওই ICCPR বর্ণিত অধিকারগুলোর কথাই বলা রয়েছে।

ছ) ICCPR এর ১৪(৩)(চ) ধারায় বিনাখরচে অনুবাদকের কথা বলা হয়েছে । যা আমাদের ICTA-1973 এর ১০(২) ও ১০(৩) ধারাতে বর্ণিত রয়েছে।

জ) ICCPR এর ১৪(৩)(ছ) ধারায় “Right not to be compelled to testify against himself or to confess guilt” বলা হয়েছে । যা আমাদের ICTA-1973 এর ৮(৫) ও ১৮ ধারা দুইটি পড়লেই দেখা যাবে যে, এই অধিকার রক্ষিত হয়েছে ।

ঝ) ICCPR এর ১৪(৪) ধারায় আন্ডার এইজের ব্যাক্তির কথা বলা হয়েছে । যা বাংলাদেশের The Children Act-1974 খুব ভালো করেই রক্ষা করে । এই আইন নিয়ে ICTA-1973 তে কোনো বাঁধা নেই।

ঞ) ICCPR এর ১৪(৫) ধারায় “right to review the conviction and sentence” এর কথা বলা হয়েছে। যা আমাদের ICTA-1973 এর ২১ ধারাতে বর্ণিত রয়েছে।

ট) ICCPR এর ১৪(৭) ধারায় “right not to be tried for offences which has been tried before” এর কথা বলা হয়েছে । যা আমাদের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত রয়েছে ও উক্ত অধিকার সমুন্নত রয়েছে ।

উপরের আলোচনায় আমরা দেখতে চেষ্টা করলাম যে , আন্তর্জাতিক ভাবে , Article 14 of International Covenant on Civil and Political Rights,1966 (ICCPR) এ বর্ণিত অধিকারগুলোই আসলে একজন মানুষের অধিকার যে কোনো ট্রায়ালে নিশ্চিত করে এবং International Bar Association যখন আমাদের ১৯৭৩ সালের আইন সম্পর্কে সমালোচনা করেছিলো তখন এই অধিকার গুলো আমাদের ১৯৭৩ সালের আইনে নিশ্চিত নয় বলে জানিয়েছিলো।

উপরের আলোচনায় আমরা দেখতে চেষ্টা করলাম যে , আন্তর্জাতিক ভাবে , Article 14 of International Covenant on Civil and Political Rights,1966 (ICCPR) এ বর্ণিত অধিকারগুলোই আসলে একজন মানুষের অধিকার যে কোনো ট্রায়ালে নিশ্চিত করে এবং International Bar Association যখন আমাদের ১৯৭৩ সালের আইন সম্পর্কে সমালোচনা করেছিলো তখন এই অধিকার গুলো আমাদের ১৯৭৩ সালের আইনে নিশ্চিত নয় বলে জানিয়েছিলো।

এই প্রিজাম্পশন অফ ফেয়ারনেসের উত্তরটা এখানে শেষ করবার আগে আরো কিছু অধিকারের কথা বলে নেই- যেটা আমাদের আইনেই রক্ষিত আছে। এই রিসার্চটি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরামের নিজের করা। আমি কেবল তা তুলে আমার করা অনুবাদ সহ- দেখে নেই এই ট্রাইবুনাল কি করে একটি ন্যায্য বিচারের ট্রাইবুনাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে নিজেকে। এর আগে আমরা দেখে নেই বাংলাদেশের প্রখ্যাত আইনজীবি জনাব রফিক উল হক এই বিচার নিয়ে কি বলেছেন। 

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিচারের গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। নিরপেক্ষ নয় যারা এ কথাটি বলছেন তারা বিচারকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করছেন। দীর্ঘদিন পর মানবতাবিরোধীদের বিচার হচ্ছে। আমরা সবাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। যত দ্রুত বিচার হবে ততই দেশ ও জাতির জন্য ভাল হবে। বিএনপি ও জামায়াতের আইনজীবীদের কঠোর সমালোচনা করে সুপ্রীমকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক জনকণ্ঠকে এ কথা বলেছেন। এদিকে জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করেছে তদন্ত সংস্থা। তার বিরুদ্ধে ২৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হবে। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকেই বিএনপি ও জামায়াতের আইনজীবীসহ তাদের নেতৃবৃন্দ বলে আসছেন, ট্রাইব্যুনাল নিরপেক্ষ নয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত জামায়াতের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হচ্ছে। তাদের ঐ বক্তব্য প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার রফিকুল হক আরও বলেন, ট্রাইব্যুনাল যে নিরপেক্ষ নয় তারা সে কথাটি কিভাবে বলছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। পাশাপাশি এটি আন্তর্জাতিকমানেরও। দুটি ট্রাইব্যুনালে যে ৬ জন বিচারক রয়েছেন তারাও নিরপেক্ষ বলে আমি ভাবি। বিএনপি জামায়াত এ কথা বলছে না কেন ট্রাইব্যুনাল নিরপেক্ষ না। ৪০ বছর পর বিচার শুরু হয়েছে। অনেকেই চাইছে বিচারটা বিলম্বিত বা বন্ধ করা

অন্যদিকে আমাদের ট্রাইবুনাল নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টে Paulo Casaca [founder and executive director of the South Asia Democratic Forum] বলেন,

Many of those who opposed the tribunals when they started have honestly observed them as they have progressed and now have a positive impression of them and the honest, straightforward way they have done their work. Stephen J. Rapp, U.S. ambassador at large for war-crimes issues, duly concluded in 2011 after three visits to the country: “We have full trust in the good intentions of ICT prosecutors and judges. I think these are enough for fair justice.” Based on my own observations, it is fair to say the ICT compares favourably with other tribunals being conducted around the world, particularly the one in Iraq that followed the U.S.-led operation there.

The question is whether or not the crimes of which the accused has been convicted deserve the maximum penalty allowed under the law. In this regard, my position is definitely yes. Unfortunately, those who support those accused of perpetrating genocide against the Bangladeshi people have continued to try to derail the proceedings. They have done so by launching indiscriminate terrorism campaigns against civilians and targeted assassinations of court witnesses and members of the judicial system. During a recent meeting I had with one of the prosecutors of the tribunals, he said he was receiving death threats from these individuals. He told me these threats were widespread, but would not change his course of action.

তিনি ওয়েস্টার্ন প্রোপাগান্ডা সম্পর্কে আরো বলেন যে,

In the West, however, they are waging a multimillion-dollar campaign of denial and propaganda trying to portray themselves as the innocent victims of political manoeuvring. Particularly active in this lobbying campaign has been Human Rights Watch. According to some inside the judicial system, it has waged the most aggressive and least scrupulous attacks against the Bangladeshi court proceedings. It is fascinating that this group would be standing up for those who have been convicted of murder and rape rather than their victims. Even more surprising, I understand that representatives of the organization have never actually visited the tribunals to establish a basis for its criticism.

এই কোর্টের মান সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি এও বলেন যে এটি সর্বোত্তোম মানের কোর্ট যা অন্য কোর্টকেও ছাড়িয়ে গেছে।

The Western world should not fall prey to this sort of campaign. Indeed, any comparison of Bangladesh tribunals with the principles, methods and results of recent international experiences of trials on crimes against humanity such as Cambodia, Cameroon, Iraq or Rwanda will demonstrate that the Bangladesh tribunals are comparable and even exceed the standards of these other proceedings. The Pakistani butchery committed in 1971 continues to haunt the Bangladeshi people. The tribunals are an important step toward bringing them the respect and humanity they were denied before.

এই বিচারের আইনে রক্ষিত অধিকার সমূহঃ

নীচের এই অংশটুকুর সব কিছুই মূলত দেয়া রয়েছে ট্রাইবুনালের মূল আইন এবং সেটির রুলস এন্ড প্রসিজিওরে। সেখান থেকেই আসলে নীচে প্রদত্ত চুম্বক অংশগুলো চয়ন করা হয়েছে। উপরে আমরা দেখেছি ফেয়ার ট্রায়াল বলতে মূলত যে ধারনাগুলো বা উদাহরন গুলো বলা হয়েছে সেগুলোর একটা ব্যাখ্যা। সেই হিসেবে আমাদের আইনে একজন অভিযুক্তের অধিকার কতটুকু রক্ষিত হয়েছে এটা আসলে দেখা প্রয়োজন। আমাদের আইনের দিকে একটু তাকাই এবার-

১) উল্লেখিত আইনের [International Crimes Tribunal Act-1973 (ICTA-1973)] 6(2A) ধারায় বলা রয়েছে যে এই আইনের মাধ্যমে গঠিত ট্রাইবুনালকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন হতে হবে। (1) Trial to be held in a fair, impartial and independent tribunal [Section 6(2A) of the ICTA],

২) বিচার দ্রুত সময়ে হতে হবে 11(3) (a) এবং উন্মুক্ত শুনানী হবে [Section 10(4) ICTA] ,(2) Expeditious [Section 11(3)(a)] and public hearing [Section 10(4) of the ICTA],

৩) অভিযুক্ত তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত হবেন [Section 16], (3) Accused to know of the charges [Section 16] against him,

৪) মিথ্যা কিংবা হয়রানী মূলক অভিযোগ আনা থেকে রাষ্ট্রপক্ষ বিরত থাকবেন [Rule 29(1)], (4) Prohibition of prosecution on frivolous charges [Rule 29(1)]

৫) অভিযুক্তের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হচ্ছে সেটি যদি অপর্যাপ্ত মনে হয় বিচারকের কাছে তবে তিনি অভিযুক্তকে এই সকল অভিযোগ থেকে মুক্তি দিবেন। (5) Discharge an accused if the tribunal finds insufficient grounds to continue the trial [Rule 37]

৬) স্বেচ্ছারচারী মূলক ভাবে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। শুধু মাত্র বিধি ৯ এর ৫ অনুযায়ী ট্রাইবুনালের নির্দেশের মাধ্যমে একজন ব্যাক্তিকে গ্রেফতার করা যাবে এই আইনের অধীনের কোনো অভিযোগে। (6) Prohibition of arbitrary arrest, as one can only be arrested or be detained only by the Order of the Tribunal issued under the ICTA and Rules of Procedure [Rule 9]

৭) জামিন চাইবার অধিকার রয়েছে। (7) Right to seek bail. [Rule 34(2)]

৮) সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যদি ব্যাক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ না হয় তবে সেইক্ষেত্রে অভিযুক্তের জামিন চাইবার অধিকার থাকবে। (8) Right to bail if investigation is not completed within a specified period [Rule 9(5)]

৯) নিজে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারেন এমন বক্তব্যের ব্যাপ্যারে ব্যাক্তির সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে। (9) Protection against self-incrimination [Rule 43(7)]

১০) স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর ক্ষেত্রে ব্যাক্তির রক্ষাকবচ রয়েছে। (10) Safeguards related to confessional statements [Rule 25(2) & Section 14(2)],

১১) স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী ব্যাক্তি স্বেচ্ছায় বিচারক সত্বা/ প্রতিষ্ঠান/আদালতের কাছে দিবেন। (11)Confessional statements must be voluntary and made before a judicial entity [Section 14(2)]

১২) ব্যাক্তি নির্যাতন, চাপ, ভয়ভীতি, হুমকির সম্ভাবনা রয়েছে এমন অবস্থা থেকে রক্ষাকবচ পাবেন বলা রিয়েছে বিধি ১৬(২) তে। (12) Safeguards against possibilities of torture or coercion, duress or threat of any kind. [Rule 16(2)]

১৩) প্রদত্ত সাক্ষ্য উভয় পক্ষের কাছে উন্মুক্ত হতে হবে এবং অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ফরমাল অভিযোগ, সেইসাথে তদন্তকালীন সময়ের কাগজ-পত্র অভিযুক্ত পাবার অধিকারী হবেন। (13) Disclosure of evidence [Section 18(4)] and entitlement of having copy of formal charge together with documents collected during investigation,

১৪) নতুন কোনো সাক্ষ্য যদি রাষ্ট্রপক্ষ যোগ করতে চান তবে সেটি বিবাদী পক্ষকে জানাতে হবে। (14) Notice to the defense in case of inclusion of additional witnesses by the prosecution [Section 9(4)]

১৫) বিবাদী পক্ষকে তার অবস্থান বিষয়ে প্রস্তুতি নেবার জন্য যথেষ্ঠ সময় দিতে হবে। (15) Adequate time for preparing defense [Rule 38(2)]

১৬) কাগজ-পত্র অনুসন্ধানের অধিকার রয়েছে। (16) Right to inspect documents [section 16(2)]

১৭) আইনী পরামর্শক নিয়োগের অধিকার রয়েছে (17) Engaging legal counsel [Section 17(2)]
১৮) বিবাদী পক্ষের আইনী পরামর্শক না থাকলে রাষ্ট্র নিজ খরচে আইনী পরামর্শক নিয়োগ দেবেন। (18) Appointing defense counsel at state’s expense [Rule 43(1) and Section 12 of ICTA]

১৯) অভিযুক্ত নিজেই নিজের মামলা পরিচালনা করতে পারবেন। (19) Right to conduct own defense [section 17(2)]

২০) বাংলাদেশ বার কাউন্সিল রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে ট্রাইবুনাল বিদেশী আইনজীবিকে এই ট্রাইবুনালে তার ক্লায়েন্টের পক্ষে লড়বার অনুমতি দিতে পয়ারে। (20) The tribunal may allow appearance of foreign counsel defense if Bangladesh Bar Council (i.e., The regulatory authority for practicing lawyers) permits so (Rule 42)

২১) অভিযুক্তের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আসবে সেটির ব্যখ্যা তিনি চাইতে পারেন। এই অধিকার তার রয়েছে। (21) Right of the accused to explain charges [Section 17(1)]

২২) ভাষা বুঝতে সমস্যা হলে দোভাষীর সুযোগ রয়েছে। (22) Availing services of an interpreter [Section 10(3)],

২৩) বিবাদী তার মামলা উপ্সথাপন করতে পারবেন এবং সেই সাথে তিনি বাদী পক্ষের আনীত সাক্ষীকে পালটা জেরা করতে পারবেন। (23) Full opportunity to present the case of the defense including the right to cross examine prosecution witnesses [section 17(3)],

২৪) বিবাদী পক্ষ তাদের পক্ষে সাফাই সাক্ষী আনতে পারবেন। (24) Right to call their own defense witnesses [Section 10(1)(f)]

২৫) বিবাদী তার পক্ষে সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে পারবেন। (25) Right of the accused to produce evidence in support of his defense [section 17(3)],

২৬) ট্রাইবুনাল প্রদত্ত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে পুনঃসিদ্ধান্তের আবেদন করতে পারবেন। (26) Review of the decisions of the Tribunal [Rule 26 (3)],

২৭) ট্রাইবুনালের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপীল করতে পারবেন। (27) Right to appeal against both conviction and sentence [section 21(1)]

উপরের অধিকার ও সুযোগ গুলো ছাড়াও অনেক সুযোগ সুবিধা এই আইনে রয়েছে। যেমনঃ

২৮) অভিযুক্ত মামলা চলাকালীন সময়ে নির্দোষ বলেই বিবেচিত হবেন। (28) Presumption of innocence (Rule 43(2)

২৯) অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ করবার দায় বাদীর/ রাষ্ট্রপক্ষের। (29) Burden of Proof on prosecution beyond reasonable doubt (Rule 50)

৩০) বিচারিক কার্যক্রম যাতে দ্রুত হয়, সেই অধিকার রয়েছে অভিযুক্তের। (30) Right to speedy trial [Rule 43(5)]

৩১) নিজে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারেন এমন বক্তব্য ও জবানবন্দীর ব্যাপ্যারে ব্যাক্তির সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে। (31) Prohibition of self-incrimination or making confession [Rule 43(7)]

৩২) একই অপরাধে দুইবার শাস্তি না দেয়ার ক্ষেত্রে সুরক্ষা রয়েছে। (32) Protection against double jeopardy [Rule 43(3)]

৩৩) সাক্ষী এবং ভিকটিমের জন্য সুরক্ষার ব্যাবস্থা রয়েছে। (33) Provision of witness and victim protection [Rule 58A]

৩৪) বিচারিক কার্যক্রম প্রয়োজনবোধে গোপনে করবার ব্যাবস্থা রয়েছে। (যেসব ক্ষেত্রে সাক্ষীরা নিজেদের পরিচয় পরকাশ করতে চান না)[34] Provision for proceedings in camera [Rule 58A (3)]

৩৫) Failure to prove the plea of alibi and or the documents and materials by the defence shall not render the accused guilty.

উপরের আলোচনা থেকে খুবই স্পস্ট ভাবেই প্রতীয়মান হয় যে এই বিচার যে কতটা নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু উপায়ে হচ্ছে। মূলত এর পর আর প্রশ্ন থাকাই উচিৎ নয় বলে আমি মনে করি। এই বিচারের ব্যাপারে আস্থার ব্যাপারে কয়েকটি “ট্রিকি” পর্যবেক্ষন করেছি আমি। সেখানে দেখা গেছে, অভিযুক্তদের আইনজীবি ট্রাইবুনালের রায়ের পর উচ্চ আদালতে যাবার প্রাক্কালে বার বার বলেছেন, “আমরা আশা করি উচ্চ আদালতে ন্যায় বিচার পাব”, মজার ব্যাপার হচ্ছে ফামা যেই বিদেশী সংস্থার কথা বলছেন সেসব বিদেশী সংস্থার এক্টি ইন্টারন্যশনাল বার এসোসিয়েশান এই বিচারের আইনের কিছু সংশোধন দরকার বলে রিকমেন্ড করবার পরেও তারা এটা স্পস্ট করে উল্লেখ করেছে যে- ‘broadly compatible with current international standards.’ [Conclusions’, IBA Legal Opinion, 29 December 2009,]

যাই হোক, ফেয়ার জাস্টিস হচ্ছে কি হয়নি সেটির প্রমাণ আমি যুক্তি, আইনী ব্যাখ্যা দিয়ে দেখাবার চেষ্টা করেছি আবেগের বসে চিৎকার, চেঁচামেচি করবার সুযোগ এখানে একেবারেই নেই। যা বলার বলতে হবে এই ট্রাইবুনালকে, ট্রাইবুনালের কার্য প্রক্রিয়াকে, আইনকে, রুলস এন্ড প্রসিজিওর পুরো-পুরি বিচার বিশ্লেষন করেই।

ফেয়ার ট্রায়াল প্রশ্নঃ বিবাদী পক্ষের অসামঞ্জস্যপূর্ণ বক্তব্য

আমার লেখায় আমি এই অংশটি রেখেছি এই লেখার সবচাইতে ইন্টারেস্টিং এবং উপভোগ্য মনে করেই। আপনারা জানেন যে এই বিচার শুরু হবার পর থেকেই বিবাদী পক্ষের নিয়োজিত আইনজীবিরা সারা পৃথিবীতেই তাদের লবিস্ট, বিদেশী আইনজীবি ইত্যাদির মাধ্যমে এই বিচার নিয়ে নানা ধরনের মিথ্যে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। সেসব প্রোপাগান্ডার সূত্র ধরেই বিবাদী পক্ষের একজন বৃটিশ আইনজীবি টবি ক্যাডম্যান এই চলমান বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তার চলমান সমালোচনার প্রেক্ষিতে একটি পাঁচ পাতার স্টেটমেন্ট দেন। স্বাভাবিক ভাবেই এই স্টেটমেন্ট নজরে আসে আদালতের। ট্রাইবুনালে উপস্থিত বিবাদী পক্ষের দেশী আইনজীবি তাজুল ইসলামকে আদালত তখন প্রশ্ন করতে থাকে এবং টবি ক্যাডম্যানের সমালোচনার প্রেক্ষিতে আদালত তার কাছে একটা একটা করে সমালোচনার কথা জিজ্ঞেস করতে থাকে। এ সময় আদালতের সামনে জনাব তাজুল ইসলাম যা উত্তর দেন সেটিতে স্পস্টত প্রতীয়মান হয় যে টবি ক্যাডম্যান যেসব বিষয় উল্লেখ করে এই আদালতের সমালোচনা করেছেন তা মিথ্যে এবং তা প্রতীয়মান হয়েছে আসামী পক্ষের আইনজীবি তাজুল ইসলামের উত্তরেই। টবি ক্যাডম্যানের এইসব সমালোচনার মধ্যে ছিলো আসামীকে গ্রেফতারের পর পরই তাকে কেন গ্রেফতার করা হয়েছে সে কারন তাকে জানানো, আদালতের সামনে দ্রুত হাজির করা, তার গ্রেফতার কে চ্যালেঞ্জ করে আবেদন এবং আসামীর জামিনের জন্য আবেদন।

এই চারটি ক্ষেত্রেই যখন আইনজীবি তাজুলকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো তিনি সেগুলোর যা উত্তর দিয়েছিলেন তাতে দেখা গিয়েছিলো যে এইসব আলোচ্য অধিকার সমূহ সব কিছুই একজন অভিযুক্তের ক্ষেত্রে রক্ষিত রয়েছে। যে ফেয়ার ট্রায়ালের কথা আমরা এতক্ষন উপরে আলোচনা করেছি, আই সি সি পি আর কিংবা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন স্ট্যান্ডার্ডের সাথে মিলিয়ে দেখিয়েছি সেটির সাথেই খোদ আসামী পক্ষের আইনজীবি তাজুল ইসলামের উত্তর মিলে যায়। অথচ আসামী পক্ষের বিদেশী আইনজীবি তা সরাসরি অস্বীকার করেছেন। এই একই দলভুক্ত দুইজন আইনজীবির কথার বৈপিরত্য একদিকে যেমন আসামী পক্ষের ফেয়ার ট্রায়াল হয়নি, এমন দাবীকে অসাড় প্রমাণ করে ঠিক তেমনি এটাও প্রমাণিত হয় যে এই ট্রাইবুনাল একজন অভিযুক্তকে আইনী কাঠামোর মধ্যে থেকে প্রাপ্য ও রিজেনেবল সকল রকমের অধিকার দেবার জন্যই প্রস্তুত। এই পুরো ব্যাপারটি বিস্তারিত লেখা রয়েছে এই ট্রাইবুনালের আরেকজন সমালোচক ডেভিড বার্গম্যানের নিজস্ব ব্লগে। আমি সেখান থেকেই হুবুহু তুলে দিচ্ছি পাঠকদের পুরো ব্যাপারটি বুঝবার সুবিধার্থে। উল্লেখ্য যে এই ডেভিড বার্গম্যানিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত-২ গত ২শরা ডিসেম্বর আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যাস্ত শাস্তি প্রদান করে এবং সাম্প্রতিক সময়ে আপীলেট ডিভিশানের শিষ্ঠাচার অমান্য করে আদালতে মোবাইল দিয়ে কথা বলবার অপরাধে কোর্ট থেকে বের করে দেয়া হয়।

In the five page statement, one paragraph read, 'Persons arrested on the basis of reasonable suspicion of having committed a criminal offence are also entitled, under international law, to a number of additional safeguards. For example being brought promptly before a judge, being provided with information detailing the nature of the allegations, being entitled to challenge the lawfulness of custody and independently of this being entitled to make a reasoned bail application.’ 

In bold type, the statement added, ‘None of these rights have been made available.’

At the beginning of Monday’s Tribunal hearing, the Tribunal chair read out the paragraph and asked Tajul Islam, the accused’s main Bangladeshi counsel to answer questions about the accuracy of this claim.

‘Was [the accused] not brought in front of this court as early as possible after issuance of warrant?’ Islam said, ‘yes’

‘Being provided with information detailing the nature of the allegations was he not provided with this?’ the tribunal chairman further asked. ‘Yes,’ said Islam.

‘Lastly, being entitled to challenge the lawfulness of custody and independently of this being entitled to make a reasoned bail application, didn’t you do it?’ Islam again responded, ‘Yes’.

The Tribunal chairman then criticized Islam for failing to inform Cadman that his views were wrong, ‘Why didn’t you do anything against this?’ he asked. Judge AKM Zahir Ahmed added, ‘Mr Tajul, as a Bangladeshi citizen, do you think such comments from a foreigner are acceptable?’

 Islam responded by saying, ‘It is his responsibility. I don't take any responsibility … I have nothing to comment on this.’

However, after the hearing, Islam told New Age that he had no option but to agree with what the Tribunal asked him. ‘I had no option to say, yes. They were leading questions.’

He told New Age that he in fact agreed with Cadman on three of the four criticims that he had made. ‘The accused have not been given copies of the allegations against them. They have only been given copies of the application filed for warrant of arrest and subsequently for interrogation,’ he said. ‘This is not the same as the copy of the allegation against them.’

In relation to being able to challenge the lawfulness of the accused’ custody, Islam said that in the defence lawyers; view ‘the law did not allow detention prior to the framing of the charges, and there had been no way of appealing the Tribunal’s decisions involving detention.’

On the issue of the bail application, he said, ‘We have made a bail application, but the order given by the Tribunal was not reasoned. The reasons that were given in our application were not reflected in the order of the Tribunal.’

 He however said that Cadman was wrong to suggest that the accused were not brought promptly before the tribunal after a warrant for their arrest was issued.

 Following the Tribunal’s rebuke of the British lawyer, the Tribunal passed two orders on Monday - one directing the jail authorities to provide improved transport to the accused when they travelled from jail to the Tribunal, and the other to allow Delwar Hossain Sayedee to be able to visit the Cardiac Hospital and Research Institute when necessary. 

উপরের আলোচনা থেকে এটা অত্যন্ত স্পস্ট যে বিবাদী পক্ষের সমালোচনা গুলো এই বিচার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবার ই একটা হীন প্রচেষ্টা মাত্র। বিচারের যে মান রক্ষিত হচ্ছে সেটা গোপন করে যখন সারা পৃথিবীর কাছে অপরাধীদের রক্ষা করাটাই হয়ে ওঠে এইসব প্রোপাগান্ডার মূল উদ্দেশ্য তখন যে এই জাতীয় ম্যালফ্যাংশন হতে পারে খোদ বিবাদী পক্ষের দুই আইনজীবির মধ্যে সেটি উপরের এই উদাহরন পড়লেই আসলে পরিষ্কার হয়ে পড়ে। 

চৌধুরী মইনুদ্দিনকে যুক্তরাজ্য এবং আশরাফুজ্জামান খানকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে নেবার ব্যাপারে আইনী বিষয়াদির পর্যবেক্ষণঃ

উপরের এইসব আলোচনার প্রেক্ষিতে চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিচার বিষয়ক একটি আলোচনা হয়ত হয়েছে কিংবা এই ব্যাপারে হয়ত বিশদ জানাও গেছে কিন্তু এই পুরো বিচার-ই মূলত ব্যার্থতায় পরিণত হবে যদি এই দুই কনভিক্টেড অপরাধীকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করা না যায়। বাংলাদেশের রাজনীতি আর তার দীর্ঘ মারপ্যাঁচে স্বাভাবিকভাবেই এই দুই অভিযুক্তের ব্যাপারে আর কোনো পদক্ষেপ স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর্যন্ত না নেয়া হলেও এটা সত্য যে এই দুই অভিযুক্তের ব্যাপারে সাধারণ জনতা কিংবা ভিক্টিম পরিবারের সদস্যরা বরাবরই উচ্চকিত ছিলেন এবং বৃটেন-আমেরিকার মিডিয়াও সব সময় উচ্চকিত ছিলো। এত কষ্ট, ত্যাগ ও সংগ্রামের পর অবশেষে এই অপরাধীর বিচার বাংলাদেশের মাটিতে হয়েছে। কিন্তু অপূর্ণতা রয়েই গেছে শেষ পর্যন্ত। কেননা এই দুই খুনী এই দেশে নিরাপদে জীবন যাপন করছে এবং এই চলমান ট্রাইবুনালের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ক্রমাগত বিষেদাগার করেই চলেছে।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ভুক্ত দেশ কিংবা পশ্চিমা বেশীরভাগ দেশ-ই যে কোনো বিচারে মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে একটি অবস্থানে এসে পৌঁছেছে এবং এই অবস্থানের কারনে চৌধুরী মইনুদ্দিনকে বাংলাদেশে ফেরত নেবার ক্ষেত্রে একটি জটিলতা তৈরী হয়েছে। চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানকে দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আইনী একটা অবস্থান এই লেখায় তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক বলেই আমার মনে হয়েছে বিধায় এই বিষয়ে কিছু বলবার চেষ্টা করব। প্রথমত যদি যুক্তরাজ্যে বসবাসরত চৌধুরী মইনুদ্দীনের ব্যাপারে আলোচনা করি তবে এটা দেখা আবশ্যক যে ইংল্যান্ডে এক্সট্রাডিশন [ এক্সট্রাডিশন হচ্ছে একটি আইনী ফর্ম বা প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি দেশ থেকে আরেকটি দেশে একজন অপরাধীকে স্থানান্তর করা যায় আলোচ্য দেশের সাথে এই বিষয়ক কোনো এক পক্ষীয় বা অনেক দেশের সমন্বিত এই বিষয়ের উপর কোনো চুক্তির উপর ভিত্তি করে। যদিও এই ধরনের চুক্তিতে নানাবিধ শর্ত থাকতে পারে এবং যে দেশটি অপরাধী ব্যাক্তিকে অন্য দেশ থেকে চাইছে সেটির ক্ষেত্রেও নানাবিধ দীর্ঘ আনুষ্ঠানিকতা থাকে।

যুক্তরাজ্যের এক্সট্রাডিশন আইন-২০০৩ এর মাধ্যমে এই বিষয়ক ব্যাপারগুলো ব্যবস্থাপনা করা হয়। এই আইনের দুইটি অংশ আছে মূলত। একটা অংশ পার্ট-১ যে অংশ প্রজোয্য ইউরোপিয়ান দেশগুলোর ক্ষেত্রে। এবং পার্ট-২ এর অংশের যে দেশগুলোর কথা রয়েছে সেটি মূলত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাইরের দেশগুলোর ক্ষেত্রে প্রজোয্য এবং এই অংশকে সূচিত করা হয়েছে ক্যাটাগোরী-২ নামে সূচিত করে। এই ক্যাটাগোরি-২ আবার দুইভাগে বিভক্ত। একটি অংশের ক্ষেত্রে মূলত দেখাতে হয় যে সে অংশের অনুরোধের প্রেক্ষিতে “প্রাইমাফেসি” এভিডেন্সিয়াল উপকরন রয়েছে কি না, অন্য অংশের তা দেখাতে হয়না। তাদেরই এই Prima Facie Eveidencial Case দেখাতে হয়না যারা ইতিমধ্যেওই European Convention of Extradition 1957 এর সাক্ষরকারী দেশ। বাংলাদেশ এই কনভেনশনের সাক্ষরকারী দেশ না বিধায়-ই বাংলাদেশকে প্রথমেই দেখাতে হবে যে ব্যাক্তিকে তারা চাইছে তার ব্যাপারে অভিযোগ রয়েছে, তার ব্যাপারে প্রাইমা ফেসি এভিডেন্সিয়াল case রয়েছে। উক্ত আইনের ৮৪ ধারা মোতাবেক এই ব্যাপারটিও আবার প্রমাণ করতে যেতে হবে আদালতে যেখানে জাজ এই প্রাইমাফেসি এভিডেন্সিয়াল কেইসের পুরো ব্যাপারটি যাচাই করে দেখবেন। বাংলাদেশ যেহেতু ক্যাটাগোরি-২ ভুক্ত দেশ এবং আলোচ্য কনভেনশনেরও সিগ্নেটোরী দেশ নয় সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রথমে যুক্তরাজ্য সরকারের কাছে এই মইনুদ্দিনের ব্যাপারে আবেদন করতে হবে। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে যা যা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রয়েছে সেগুলোও সাবমিট করতে হবে এই আবেদনের সাথে।

সবকিছু ঠিক থাকলে সেক্রেটারী অফ স্টেট এই আবেদন পাঠাবেন বিচারপতির কাছে। বিচারপতি এই ক্ষেত্রে অভিযুক্তের ব্যাপারে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করতে পারবেন। এই গ্রেফতারী পরোয়ানার পর আদালতে এই ব্যাপারে শুনানী হবে এবং সে প্রেক্ষিতে আদালত দেখবেন যে সাংবিধানিক কিংবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ হবার কারনে এই ক্ষেত্রে কোনো ক্ষেত্রে উক্ত অভিযুক্তকে পাঠাবার ক্ষেত্রে কোনো বাঁধা রয়েছে কি না। বাঁধা না থাকলে বিচারপতি এই বিষয়ে সেক্রেটারী অফ স্টেটকে অভিহিত করবেন এবং তিনিই পরবর্তী ব্যাবস্থা নেবেন। সেক্রেটারী অফ স্টেট অতি অবশ্যই একটি ব্যাপার লক্ষ্য রাখবেন যে আলোচ্য আইনের ৯৩(২) ধারার প্রেক্ষিতে তার কোনো আইনী বাধ্য বাধকতা রয়েছে কি না। এই বাধ্য বাধকতার একটি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড। যেহেতু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে অভিযুক্ত মইনুদ্দিন মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হয়েছে সেহেতু আলোচ্য এই ইউকে’র এক্সট্রাডিশন আইনের ৯৪(১) ধারা মোতাবেক উক্ত অভিযুক্তের ক্ষেত্রে এক্সট্রাডিশন অর্ডার দিতে পারবেন না যদিও ওই একই আইনের ৯৪(২) এ রয়েছে যে যদি আবেদনকারী রাষ্ট্র যুক্তরাজ্যকে এই নিশ্চয়তা দেয় যে অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে আবেদনকারী রাষ্ট্রে পাঠালে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে না তবে সেক্ষেত্রে তিনি এক্ট্রাডিশন অর্ডার দিতে পারেন। এর মধ্য এটিও উল্লেখ্য যে আলোচ্য আইনের ৯৩(২) ধারাতে বর্ণিত কোনো বিষয়াদি যেটার প্রেক্ষিতে সেক্রেটারী অফ স্টেট এই এক্সাডিশন করতে অপারগ সেক্ষেত্রে তিনি এক্সট্রাডিশন অর্ডার দিতে পারবেন না, অন্যথায় তিনি এই অর্ডার দিবেন এবং এই ক্ষেত্রে অভিযুক্তের পক্ষে কোনো ডিস্ক্রিশনও প্রয়োগ হবে না।

আদতে একটা ব্যাপার খুব পরিষ্কার যে, এই ট্রাইবুনালে শাস্তি হিসেবে যে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে সেটি বহাল থাকলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন দেশ সমূহের এই বিষয়ে যে নীতি সেক্ষত্রে মইনুদ্দিনকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে। তবে এই কথা অনস্বীকার্য যে দুই দেশের কূটনীতিক পর্যায়ে আন্তরিক আলোচনার মাধ্যমে অনেক কিছুই সম্ভব।

আমার জানামতে যুক্তরাজ্যের সাথে বাংলাদেশের কোনো বন্দি বিনিময় চুক্তি নেই কিংবা এই মইনুদ্দিন বিষয়ে যুক্তরাজ্যের সাথে বাংলাদেশের কি আদৌ কোনো যোগাযোগ বা আলোচনা হয়েছে কিনা সেটির ক্ষেত্রেও আমরা অন্ধকারে রয়েছি। এখানে এই আইনের মার প্যাঁচে যদি মইনুদ্দিনের মত এত বড় একজন খুনীর সাজা না হয় কিংবা সে শাস্তি না ভোগ করতে পারে তবে একদিকে যেমন “মানুষের জন্য আইন, আইনের জন্য মানুষ নয়” এই জুরিস্প্রুডেনশিয়াল ধারনা মার খেয়ে যাবে তেমনি আইনের ফাঁকে পড়ে একজন অপরাধী সাধারন নাগরিকদের মত যুক্তরাজ্যে ঘুরে বেড়াবে, এটি যুক্তরাজ্যের পত এমন একটি সভ্য দেশের জন্য ক্ষতিকর। একজন খুনী যখন সামাজিক ভাবে আইনের জটিলতায় মুক্ত অবস্থায় ঘুরতে পারে সেটি ওই দেশের সাধারণ নাগরিকদের জন্য হুমকি ও শংকারও বটে। আগামী দিনে যদি বৃটেনের ইতিহাসে লেখা হয় যে বৃটেন কিংবা ইউরোপ এই ধরনের অপরাধীদের জন্য স্বর্গস্বরূপ তবে সেটি পুরো মানব সভ্যতার জনই লজ্জার হয়ে দাঁড়াবে।

এখানে একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয় যে ২০০৪ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৩৩ জন বৃটিশ নাগরিককে আমেরিকায় এক্সট্রাডিক্ট করা হয়েছে যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এই পরিসংখ্যান থেকেই এটি বোঝা যায় যে আন্তঃদেশীয় উষ্ণ সম্পর্ক, কূটনৈতিক ভাবে ভালো যোগাযোগ, এপ্রোচ কিংবা রাজনৈতিক কিংবা ভূ-রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নানা কৌশলের মাধ্যমেও এই ধরনের আপাতঃ দৃষ্টিতে জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভব।

যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত অভিযুক্ত আশরাফুজ্জামানের ক্ষেত্রেও আইন যুক্তরাজ্যের মতই বলা যায় এক রকম যদিও যুক্তরাষ্ট্র এর ক্ষেত্রে কড়াকড়ি যুক্তরাজ্য থেকে কম এবং আমেরিকা এই ব্যাপারে অনেকটা লিনিয়েন্ট আচরন করে। আমেরিকান একজন নাগরিক Amanda Knox ইটালিয়ান একজন নাগরিককে সেই দেশে খুন করে আমেরিকায় পালিয়ে এলে ইটালী দীর্ঘদিন ধরে আমান্ডার এক্সট্রাডিশনের জন্য আমেরিকার কাছে বলে আসছে। এই ব্যাপারে প্রসিজিওরাল অবস্থানটা দেখলে আশরাফুজ্জামানের ক্ষেত্রে অবস্থানটাও কিছুটা পরিষ্কার হতে পারে।

Any request to extradite Amanda Knox would go to the U.S. State Department, which would evaluate whether Italy has a sufficient case for seeking Knox’s return. If so, the State Department would transfer the case to the Justice Department, which would represent the interests of the Italian government in seeking her arrest and transfer in U.S. District Court. American courts have limited ability to review extradition requests from other countries, but rather ensure the extradition request meets basic legal requirements, said Mary Fan, a former U.S. federal prosecutor who teaches law at the University of Washington in Seattle.

আশরাফুজ্জামান এখন আমেরিকান নাগরিক। যদিও এই ক্ষেত্রে আমেরিকার আইন 18 U.S. Code § 3196 অনুযায়ী Extradition of United States citizens:

If the applicable treaty or convention does not obligate the United States to extradite its citizens to a foreign country, the Secretary of State may, nevertheless, order the surrender to that country of a United States citizen whose extradition has been requested by that country if the other requirements of that treaty or convention are met.

যুক্তরাষ্ট্রের উপরে উল্লেখিত আইন দ্বরাই স্পস্ট বুঝতে পারা যায় এক্সট্রাডিশনের ব্যাপারে তাদের অবস্থান। আগেই বলেছি কিছু ক্ষেত্রে তাদের নাগরিক সত্বেও যুক্তরাষ্ট্র এক্সট্রাডিশন আইনের প্রতি শিথিল। এ ব্যাপারে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে কি লেখা থাকবে বা রয়েছে তার উপর নির্ভর করে পুরো প্রক্রিয়া। বলা যেতে পারে বল এখন বাংলাদেশ সরকারের কোর্টে। আশরাফুজ্জামান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ কতটা এক্সটেন্টে কিংবা কিভাবে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালাবে, সেটার উপর নির্ভর করবে এই খুনী তার এইসব ঘৃণ্য কর্মকান্ডের শাস্তি বাংলাদেশের মাটিতেই ভোগ করতে পারবে কি পারবে না।

একটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয় যে ইটালী ইউরোপিয়ান ইউনিয়িনভুক্ত দেশ এবং সেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড না থাকবার ফলেও আমান্ডার এক্সট্রাডিশন বিলম্বিত হচ্ছে অনেকটা রাজনৈতিক কারনেই বলে মনে করছেন অনেকেই। এর আগেও বঙ্গবন্ধুর খুনী মহিউদ্দিনকে আমেরিকা থেকে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে। সুতরাং আশরাফুজ্জামানের ক্ষেত্রে এই ধরনের একটা প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। সুতরাং এই ক্ষেত্রে আইনী জটিলতা ইউরোপিয়ান দেশগুলোর চাইতে কম। এই ক্ষেত্রে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও তার প্রেক্ষিতে যোগাযোগ।

 উপসংহার

এই লেখাটি সম্মিলিতভাবে একাত্তরের দুইজন অভিযুক্ত যুক্তরাজ্য প্রবাসী চৌধুরী মইনুদ্দিন এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আশরাফুজ্জামান খানের উপর ট্রাইবুনাল-২ এর প্রদত্ত রায়েরই একটি বিশ্লেষন এবং তার প্রেক্ষিতে তাদেরকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেয়া কিংবা বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে চৌধুরী মইনুদ্দিনকে দেশে ফিরিয়ে নেবার ক্ষেত্রে যে ক্যাম্পেইন চলছে সেটিরই অংশ। আমি ব্যাক্তিগতভাবে যেহেতু যুক্তরাজ্যে বসবাস করি এবং এখানকার ক্যাম্পেইনের সাথে সরাসরি জড়িত সেই ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংবাদ গুলো সম্পর্কে কিছুটা ধারনা রাখি, এমনটা বলা যেতে পারে। এরই মধ্যে চৌধুরী মইনুদ্দিনকে দেশে ফিরিয়ে নেবার দাবীতে বর্তমানে অনলাইন ও অফলাইনে ক্রমাগত ভাবে সাক্ষর সংগ্রহ অভিজান চলছে। এরই মধ্যে লিডস, ব্র্যাডফোর্ড, ম্যাঞ্চেস্টার, লন্ডন ইত্যাদি শহরে শত শত মানুষ এই দাবীতে স্বতস্ফূর্তভাবে সাক্ষর দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের এই সাক্ষর সংগ্রহের একটি প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি তীব্র জনমত গড়ে তোলা এবং একাত্তরের এই নৃশংস দুই খুনীকে দেশে ফিরিয়ে নেবার ক্ষেত্রে একটি সম্মিলিত দাবী সরকারের কাছে পৌঁছানো।

এসব কিছু বিবেচনা করেই আমরা চাই-

১) মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যের যে অনাস্থা কিংবা অনাগ্রহ সেটির কারনে একটি আইনী প্রতিবন্ধকতা তৈরী হলেও সেটির ক্ষেত্রে আমরা চাই বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে এই বিষয়ক একটি সফল আলোচনা ও সিদ্ধান্তের। অবিলম্বেই আমরা বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে এই বিষয়ক সুনির্দিষ্ট কূটনৈতিক পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্ত দেখতে চাই। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি যে বৃটেনে বসবাসরত ইসলামিক মৌলবাদী আবু হামজাকে আমেরিকায় বিচারের জন্য এক্সট্রাড্রিক্ট করা হয়েছে যদিও আমেরিকায় সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড রয়েছে। এই উদাহরনটি সামনে রেখেও বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা হতে পারে। একইভাবে আমরা চাই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাথে এই বিষয়ে বাংলাদেশের কূটনৈতিক আলোচনা এবং আশু পদক্ষেপ।

২) আপনারা জেনে থাকবেন যে বৃটেনে প্রবেশের সময় যে কোনো ব্যাক্তিকেই একটি আবেদন ফর্ম পূরণ করতে হয় এবং সেখানে খুব সু-স্পস্টভাবে উক্ত ব্যাক্তির অতীতে কোনো অপরাধের রেকর্ড রয়েছে কিনা কিংবা কিছু সু-নির্দিষ্ট অপরাধ যে মন গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদিতে সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা কিংবা এইসব উল্লেখিত ব্যাপারে অভিযোগ রয়েছে কি না সেসব ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের সরকারকে অবহিত করতে হয়। যেহেতু ১৯৭১ সালে চৌধুরী মইনুদ্দিন একজন পলাতক ব্যাক্তি হিসেবেই বাংলাদেশ সরকারের কাছে লিপিবদ্ধ ছিলো এবং যেহেতু উল্লেখ্য অপরাধের ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে সু-স্পস্ট অভিযোগ ছিলো সেহেতু যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করবার সময় চৌধুরী মইনুদ্দিন আবেদন ফর্মের মধ্যে উল্লেখিত বিষয়ের ব্যাপারে কি তথ্য দিয়েছে এই বিষয়ে যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি আমরা অনতিবিলম্বে তদন্তের দাবী জানাই এবং তদন্তে যদি চৌধুরী মইনুদ্দিনের অপরাধ প্রমাণিত হলে তার বৃটিশ নাগরিকত্ব বাতিলের দাবী জানাই।

৩) চৌধুরী মইনুদ্দিন যেহেতু একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে দোষী সাব্যাস্ত হয়েছে, সুতরাং বৃটেনে সে যতসব প্রতিষ্ঠানের সাথে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে সেগুলো সবগুলো থেকে তাকে বহিষ্কার করতে হবে।

৪) যে আইনের যুক্তিতে তথা যে মৃত্যুদন্ডের প্রেক্ষাপটের ও অবস্থানের কথা বলে চৌধুরী মইনুদ্দিনকে বাংলাদেশে হস্তান্তর করা হচ্ছেনা সেক্ষেত্রে কি তাহলে আইনের এই ফাঁকের ফলে যুক্তরাজ্য এমন ভয়াবহ গণহত্যাকারী, খুনীদের জন্য অভয়রাজ্য হয়ে উঠবে? আমরা যারা যুক্তরাজ্যে বসবাস করি, তবে কি আমরা এভাবে আইনের এমন অসাড়তায় এমনটি-ই মনে করে নেব যে বৃটেন এখন একজন গণহত্যাকারীর জন্য নিরাপদ স্থান? এই ব্যাপারে যুক্তরাজ্য সরকারের কাছের আমরা তাদের সু-স্পস্ট অবস্থান জানতে চাই।

যেই ৩০ লক্ষ প্রাণ এই দেশের জন্য, এই দেশ মাতৃকার জন্য বিলীন হয়েছে, যেই অত্যাচার, নির্যাতন, বঞ্চনা আমাদের মায়েরা, শিশুরা, বোনেরা, ভাইয়েরা কিংবা স্বজনেরা সয়েছে ১৯৭১ সালের দীর্ঘ ৯টি মাস, সেসব অন্যায়ের যথাযথ বিচার নিশ্চিত করনে আমরা কি আদৌ গত ৪৩ বছর সঠিকভাবে কাজ করে যেতে পেরেছি? এই মামলার রায়ে আদালতের কয়েকটি বক্তব্যে মাথা হেঁট হয়ে যায়। আদালত তার রায়ে বলেন-

418. It is indeed a great shame for the nation that the government [Ziaur Rahman regime and H.M Ershad regime] allowed Chowdhury Mueen Uddin who went into hiding and later on fled to aborad, to visit his native village under police protection and protocol. Instead of being condemned Chowdhury Mueen Uddin was rather honoured by state machineries. What a shame! What a shame! This fact indubitably shakes and debases the nation. It increases the trauma sustained by the victims’ family which caused a further attack to civilization.

অথচ আদালতে দাঁড়িয়ে নিহত বুদ্ধিজীবির সন্তান প্রফেসর অনির্বান যখন ডুকরে কেঁদে ওঠেন এবং বলেন- “I did not get a chance to call out my father as ‘baba’ [father]. But I have always cherished the name of Bangladesh in my heart,” তখন খুব স্পস্টতই মনে হয় মুক্তিযুদ্ধ আসলে শেষ হয়নি। এই দুই অপরাধীকে বাংলাদেশে ফেরত না আনা পর্যন্ত, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যারা আন্তর্জাতিক অপরাধ করেছে তাদের সর্বশেষ ব্যাক্তি পর্যন্ত শাস্তি না হলে আমরা বার বার এভাবেই পরাজিত হতে থাকব।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ