iDxJmGLYdGEv

আমি কলকাতায় রওয়ানা হয়ে গেলাম, নেতৃবৃন্দকে নিমন্ত্রণ করার জন্য। যখন সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে দাওয়াত করতে গেলাম, দেখি খাজা শাহাবুদ্দিন সেখানে উপস্থিত আছেন। শহীদ সাহেব বললেন, “আমি খুবই ব্যস্ত, তুমি বুঝতেই পারো, নিশ্চয়ই চেষ্টা করব যেতে। শাহাবুদ্দিন সাহেবকে নিমন্ত্রণ কর উনিও যাবেন।” অনিচ্ছা সত্ত্বেও শাহাবুদ্দিন সাহেবকে বলতে হল, তিনিও রাজি হলেন। মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ এবং হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী সাহেবকেও দাওয়াত দিলাম। জনাব মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী (লাল মিয়া), তখন কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগ রিলিফ কমিটির সম্পাদক। আমি তাঁর সাথেই রিলিফের কাজ করতাম, আমাকে খুবই বিশ্বাস করতেন। তিনি যথেষ্ট টাকা, ঔষধ ও কাপড় জোগাড় করেছিলেন। তাঁর সাথে সাথেই আমাকে থাকতে হত। আর প্রত্যেক মহকুমায় কাপড় পাঠাতে হত। যুদ্ধের সময় মালপত্র বুক করা কঠিন ছিল, দশ দিন ঘোরাঘুরি করলে কিছু কিছু কাপড় পাঠাবার মত জায়গা পাওয়া যেত। অনেক সময় হিসাব নিকাশও দেখতে হত। নিজের হাতে কাপড়ের গাঁটও বাঁধতে হত। আমি কোন কাজেই ’না’ বলতাম না। যাহোক, তাঁকেও গোপালগঞ্জ যেতে অনুরোধ করলাম, তিনিও রাজি হলেন। দিন তারিখ ঠিক করে আমি বাড়ি রওয়ানা হয়ে এলাম। সামান্য কিছু টাকা তুললাম শহর থেকে। আমি গ্রামে বের হয়ে পড়লাম, কিছু কিছু অবস্থাশালী লোক ছিল মহকুমায়, তাদের বাড়িতে যেয়ে কিছু কিছু টাকা তুলে আনলাম। কাজ শুরু হয়ে গেছে। লোকজন চারিদিকে নামিয়ে দিয়েছি। অথিতিদের খাবারের ভার আব্বাই নিলেন। তবে পাক হবে এক সরকারী কর্মচারীর বাড়িতে। পরে দুই পক্ষ হয়ে গেল। গোলমাল শুরু হলে শেষ পর্যন্ত গোপালগঞ্জে আমাদের বাড়িতেই বন্দোবস্ত হল। প্যান্ডেল করলাম নৌকার বাদাম দিয়ে। যাদের বড় বড় নৌকা ছিল তাদের বাড়ি থেকে দুই দিনের জন্য বাদামগুলি ধার করে অনলাম। পাঁচ হাজার লোক বসতে পারে এত বড় প্যান্ডেল করলাম, খরচ খুব বেশি হল না।

এদিকে এই কনফারেন্স বন্ধ করার জন্য অনেকেই চেষ্টা করতে আরম্ভ করল। টেলিগ্রাম করল সকল আমন্ত্রিত নেতাদের কাছে। কনফারেন্সের মাত্র তিন দিন সময় আছে, আমার কাছে তমিজুদ্দিন সাহেব ও শাহাবুদ্দিন সাহেব টেলিগ্রাম করেছেন, কনফারেন্স বন্ধ করা যায় কি না? আমি টেলিগ্রাম করলাম, বন্ধ করা অসম্ভব। সোহরাওয়ার্দী সাহেব আসতে পারবেন না বলে টেলিগ্রাম করেছেন। তিনি বোধহয় ফুড কনফারেন্সে দিল্লি বা অন্য কোথাও যাবেন। সকলে আমাকে বলল, কলকাতায় রওয়ানা হতে, কারণ যদি কেউ না আসে তবে ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে। বহু দূর দূর থেকে লোক আসবে। কনফারেন্স দুই দিন চলার কথা ছিল, তা দুর্ভিক্ষের জন্য সম্ভব হবে না। সকালে কর্মী সম্মেলন, বিকালে জনসভা হবে বলে ঠিক হল। আমি আমার সহকর্মীদের ওপর ভার দিয়ে কলকাতা রওয়ানা করলাম। তমিজুদ্দিন সাহেব পূর্বেই খুলনায় রওয়ানা হয়ে গেছেন। শাহাবুদ্দিন সাহেব, মওলানা তর্কবাগীশ ও লাল মিয়া সাহেবকে নিয়ে খুলনায় এলাম। খুলনায় তমিজুদ্দিন সাহেব সরকারি লঞ্চে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছেন। আমরা লঞ্চে উঠলাম এবং জানতে চাইলাম কেন তিনদিন পূর্বে কনফারেন্স বন্ধ করতে বললেন? জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, জনাব ওয়াহিদুজ্জামান কিছুদিন পূর্বেও হক সাহেবের সাথে ছিলেন, সদ্য মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন, তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না যে আমি চেয়ারম্যান হয়েছি আর গোপালগঞ্জে কনফারেন্স হবে। তাঁর কিছু করার নাই, আর বলারও নাই। যদিও ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তাঁরা আমাকে ও মুসলিম লীগকে বাধা দিয়েছেন। আবার সালাম খান সাহেব, জেলা লীগের সম্পাদক, বাড়ি গোপালগঞ্জ, তাঁরও আপত্তি রয়েছে এত বড় কনফারেন্স হবে তাঁকে বলা হয় নাই বা তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করা হয় নাই। তিনিও খবর দিয়েছেন যাতে নেতারা না আসেন।

আমাকে সকল নেতাই জানতেন ভাল কর্মী হিসাবে, আমাকে সকলে স্নেহও করতেন। শহীদ সাহেবও বলে দিয়েছেন সকলকে কনফারেন্সে যোগদান করতে। আমাকে অপমান করলে, আবার একবার মত দিয়ে না গেলে কলকাতায় ছাত্রদের নিয়ে যে গোলমাল করব সে ভয়ও অনেকের ছিল। সকলকে নিয়ে আমি গোপলগঞ্জ উপস্থিত হলাম। নেতারা বিরাট সম্বর্ধনা পেলেন।

অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং-১৯ ও ২০)

বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' (পর্ব-১৪)

 

0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ