না গল্প অথবা অন্য কিছু

দীপংকর চন্দ ৯ ডিসেম্বর ২০১৫, বুধবার, ১০:৫৩:০৪অপরাহ্ন বিবিধ ১৬ মন্তব্য

নর্বাক

 

প্রবেশক: এটি কোন গল্প নয়

কী করো? সানা নূরের হাস্যোজ্জ্বল মুখ।
এই যে, কথা বলছি তোমার সাথে! একটু অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিলাম আমি।
তোমাকে আমার অনেক কাছের মানুষ মনে হয়।
কারণ, তুমি যে অনেক ভালো সানা। ভালো মানুষের কাছে পৃথিবীর সব মানুষকে কাছের মানুষ মনে হয়।
না না, তুমি ভিন্ন। সানার মৃদ্যু আপত্তি। তুমি আমার বন্ধু।
অন্তর্জাল ভীষণ জটিল জায়গা সানা! উপরিতলের পৃথিবীর চাইতে জটিল! এখানে কে কার বন্ধু বোঝা মুশকিল!
এই শোনো, তুমি কী মুসলিম?
প্রশ্নের উত্তর তো তুমি জানো সানা!
বিশ্বাস করি না!
মানুষ মিথ্যেকে বিশ্বাস করতে পছন্দ করে।
তাহলে তুমি দাড়ি রেখেছো কেন?
দাড়িতে কী আমাকে ভালো দেখাচ্ছে না?
ভালো দেখাচ্ছে না মানে! ভীষণ সুইট লাগছে। এই তুমি কিন্তু কখনও দাড়ি কাটবে না!
আমি দুঃখিত সানা, হাসান ইকবালের খবর আমি নিতে পারিনি এখনও।
তুমি কী ব্যস্ত খুব?
আমি চেষ্টা করছি সানা।
তোমার ওপর আমার বিশ্বাস আছে।
প্রার্থণা করো তোমার বিশ্বাসের মূল্য যেনো দিতে পারি আমি!

আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করলাম। সানার দেয়া তথ্য অনুসারে কথা বললাম মালয়েশিয়ান কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সাথে। তারা পরিষ্কারভাবে জানালো সানা নূরের ভালোবাসার মানুষ হাসান ইকবাল এখন আর চাকরি করেন না সেখানে।
আমি হাসান ইকবালের ঠিকানা চাইলাম।
কোম্পানি অথারিটি অনুসন্ধানের যৌক্তিক কারণ জানতে চাইলো। জানতে চাইলো আমার পরিচয়।
আমি মূল কারণটি যথাসম্ভব অন্তরালে রেখে আমার পরিচয় জানালাম সবিনয়ে।
কনস্ট্রাকশন কোম্পানি নিজেদের সুবিধা অসুবিধা বিবেচনা করার জন্য কয়েকদিন সময় চাইলো।

অন্তরঙ্গ এক আড্ডায় কথা প্রসঙ্গে জানলাম কামাল ভাইয়ের ছোট শ্যালক দীর্ঘদিন ব্যবসাসূত্রে বসবাস করেন মালয়েশিয়ায়।
কাকতালীয়ভাবে মালয়েশিয়ার ওই বিশেষ অঞ্চলেরই তিনি একজন প্রভাবশালী বাসিন্দা। কোম্পানি প্রদত্ত তথ্য যাচাইয়ের সুযোগ নিলাম আমি। কথা বললাম তার সাথে।
আমার অনুরোধে শরাফত ভাই বাংলা কমিউনিটির অনেকের সাথে কথা বলে আমাকে নিশ্চিত করলেন হাসান ইকবাল মালয়েশিয়ার অন্য কোন কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হননি। দেশে ফিরেছেন।

হাসান ইকবালের ঠিকানা মুঠোয় নিয়ে যমুনা পাড়ি দিলাম।
যান্ত্রিক জলযান থেকে তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম যমুনার বিশাল স্রোতপ্রবাহের কোন অবোধ্য অংশে সংগোপনে ভেসে আছে কিনা সানা নূরের স্বপ্নের শাপলারা!
একটা ভুবনচিল উড়ে গেলো দূরে!
আমি ঘোরগ্রস্তের মতো ছুটে চললাম চিলের পেছনে!

আর কতদূর কবীর?
সামনের বাজারটার পর।
আমি তো জমির আল ছাড়া আর কিছুই দেখছি না!
ঐ গ্রামটার পেছনেই বাজার।

বাজারে বাইক থামালো কবীর।
হাটের দিন। বাজার বেশ জমজমাট।
একটা বড়ো তেলের দোকান। সুপ্রতিষ্ঠিত একটি তেল বিক্রয় কোম্পানির সাব-ডিলারশীপ নিয়েছেন দোকানের স্বত্ত্বাধিকারী।
আরে কবীর ভাই যে! কেমন আছেন? দোকানের স্বত্ত্বাধিকারী আমাদের দেখে সাদর আগ্রহে এগিয়ে এলেন সামনে।
আপনাদের এলাকায় বিশেষ একটা কাজ আছে চেয়ারম্যান সাহেব। বাইক থেকে নামতে নামতে কবীর বললেন।
কাজ পরে হইবো। আগে বসেন তো মিয়াভাই। আসেন ভেতরে।
পরিচয় করিয়ে দেই, উনি ঢাকা থেকে এসেছেন।
শুনে ব্যস্ত হলেন চেয়ারম্যান সাহেব, ঢাকার মেহমান নিয়া আসছেন আপনে আমারে ফোন না দিয়া! না না কবীর ভাই কামডা আপনে ঠিক করেন নাই!
তিনি চেচিয়ে মাথায় তুললেন দোকান।
কালাম নামের একজন দোকান কর্মচারীকে দ্রুত বাড়িতে যাবার তাড়া দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি বাড়িত যা। খাওনের এন্তেজাম কর। কইবি, বড়ো মেহমান আইছে ঢাকা থেইকা।
আমি অস্বস্তি বোধ করি চেয়ারম্যানের ভাবনার ভ্রান্তি লক্ষ্য করে।
ভ্রান্তির পরিসর বিস্তৃত হতে না দেবার অভিপ্রায়ে আমি মরিয়া হয়ে উঠলাম, বললাম ভাই, আপনি ভুল বুঝছেন বড়ো মেহমান আমি কোনভাবেই নই। আমি হাসান ইকবাল নামে এক ভদ্রলোকের খোঁজে এখানে এসেছি। এই যে তার ঠিকানা।
চেয়ারম্যান ঠিকানা দেখলেন, ভ্রু-কুঁচকে বললেন, হাসাইন্যা! মালয়েশিয়া ফেরত! কোন আকাম করছেনি মিয়াভাই!
হাসান ইকবালের সাথে আমি একটু কথা বলতে চাই। আমি শান্তস্বরে বললাম।
আপনে বড়ো মেহমান বইলা কথা! ঐ যা-তো! হাসাইন্যারে ধইরা লইয়া আয় আমার দোকানে!
না না, ভাই। আমাকে শুধু ওনার বাড়িটা একটু চিনিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন। আমি ওনার সাথে সামান্য সময় কথা বলবো।

সাদা লুঙ্গি, সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরিহিত, গলায় তোয়ালে ঝোলানো একজন সুদর্শন তরুণ আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। চোখে মুখে ভীষণ কৌতূহলের চিহ্ন তার!
আপনি হাসান ইকবাল? আমি জানতে চাইলাম।
জ্বি!
সানা নূর আমার বিশেষ পরিচিত-
আমার কথা শেষ হতে না হতেই রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে গেলো হাসান ইকবালের মুখাবয়ব!
তিনি আমার হাত চেপে ধরলেন দ্রুত। আমার সাথে এলাকার চেয়ারম্যান, প্রভাবশালী পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধির উপস্থিতি কী অস্বস্তিতে ফেললো হাসান ইকবালকে?
তিনি ভীষণ নিচুস্বরে বললেন, ভাই, আপনার সাথে আমি একটু জরুরী কথা বলতে চাই আলাদাভাবে। যদি একটু দয়া হয় আপনার!
দয়া! দয়ার প্রশ্ন আসছে কেন এখানে? আমি ঠিক বুঝলাম না বিষয়টা!

হাসান ইকবাল আমাকে নিয়ে গেলেন বাড়ির পেছনে।
হাতে চাপ আরও বৃদ্ধি করে করুণ কণ্ঠে বললেন, ভাই, বড়ো ভুল হয়ে গেছে!
কিসের ভুল? জানতে চাইলাম আমি।
বাড়িতে এসে সবার পীড়াপিড়িতে বাধ্য হয়েছি বিয়ে করতে! খোদার কসম ভাই, আমার কোন দোষ নেই!
হাসান ইকবাল আমাকে টানতে টানতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন।
উচ্চস্বরে তিনি ডাকলেন, আয়েশা! ও আয়েশা! এদিকে আসো!
মাথায় নতুন কাপড়ের ঘোমটা তোলা একজন অতি সহজ সরল গ্রাম্য অষ্টাদশী সামনে এসে দাঁড়াল আমার!
হাসান ইকবাল আর্তস্বরে বললেন, সালাম কর! সালাম কর ভাইজানকে!
না না, সালাম লাগবে না! আমি দ্রুত সরে এলাম পেছনে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকালাম আয়েশার চোখের দিকে। কেন জানি জলে ভরা তার কাজল দুচোখ!

সানা নূরের কথা কী জানে আয়েশা? মেয়েদের অতীন্দ্রিয় বোধ কী আয়েশাকে প্রেরণ করেছে কোন বেদনার বার্তা?
আয়েশার চোখের জল দেখতে দেখতে আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠলো সানা নূরের চোখের জল!
কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি নিচু করলাম মাথা।
অতি নগন্য অতি তুচ্ছ একজন মানুষ হিসেবে ভীষণ বিপন্ন বোধ করলাম!
মানুষের চোখের জল মোছাবার অতিলৌকিক ক্ষমতা যে পরমশক্তি আমাকে দেননি!

ছবি: সংগৃহীত

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ