জয়িতা,
আজ আবার রাত জাগছি। আমাদের সেই পরিচিত “ইশ্বরের আয়ুরেখার মত” দীর্ঘতম রাত। বরাবরের মতই আমার একলা ছাঁদ আর এক ফ্লাক্স কফি। রাত জাগার কারন ঘুমচক্রের পরিবর্তন। বন্ধুর ফাঁকা বাসায় দুদিনের যাচ্ছেতাই জীবনযাপনে ঘুমচক্র পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। আমার বন্ধুরা দুর্দান্ত। রাতের বাতাসে নিঃসঙ্গতা ফেরি করে বাঁচে। আমার মত। ফলাফল ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত ঘুমাচ্ছি, সারারাত জাগছি। আজ ভোরে ঘুমাব না। সারাদিনেও না। তাহলেই আবার ঠিক হয়ে যাব। এরকম আরো আগেও করেছি। কাল সারাদিনে অনেক কাজ। তারপরেও!
তুমিতো সারাদিন অফিসে ব্যস্ত থাকো। গতকাল বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দেখি তোমার একটা ফোনকল আসেনি। ভাবলাম ব্যস্ত। একসময় বলতাম তোমার চাকরী হবে আমার আগে। তোমার অফিসে গিয়ে তোমাকে একটা বেলিফুলের মালা দিয়ে খুশি করে একশো দুইশো টাকা চাইব। তুমি মাঝেমাঝে বিরক্ত হবে, পিয়নকে বলে পাঠাবে ব্যস্ত আছো তাই দেখা হবেনা। এরকম না হলেও একটা ব্যাপার ঘটেছে। তুমি একবারও বেতন পেয়ে জানাওনি। কিছু চাই কিনা জিজ্ঞেস করোনি। ব্যাপারটা অদ্ভুত।
তোমার সাথে দেখা হয়না পুরো তিনমাস হবে কাল। রামপুরা থেকে তোমাকে বাসে তুলে দিলাম, আর দেখা হয়নি। এরপর তোমার শহরে তোমার খুব কাছাকাছি হয়ে গিয়েছি দুবার। তাও দেখা হয়নি। কি অদ্ভুত ব্যাপার না? তুমি ভালো আছো তো? জগতের সবচেয়ে দূর্বোধ্য ব্যাপার তুমি। তুমি কেমন আছো এটা চট করে বলে দেয়া যায়না! আমি তোমার মত দুর্বোধ্য? বোধহয় না। আমি খুব দুর্দান্ত। আমার শৈশবের মত দূর্দান্ত! শৈশবে যেমন ছিলাম তেমন আছি। আছি না? আচ্ছা তোমার সাথে আমার দুই বিপরীত মেরুর দুজনের কিভাবে চলে গেল এতটা দিন? আমার শৈশবের নাটাই ঘুড়ি তোমাকে নাগাল পায়নি, পেলে তোমাকেও দুর্দান্ত করে তুলতাম। আমার মত। যে কখনো কাঁদেনি, কক্ষনো হারেনি। আচ্ছা সব কিছুতেই কেন আমি আমার শৈশব খুঁজে ফিরি? জানো আমি খুব মিস করি আমার শৈশব, গোল্লাছুট খেলাচ্ছলে একজনের হাত ধরা, ইকোনো কলমের পিছন থেকে কালি পড়ে ভিজে যাওয়া আমার ইউনিফর্মের বুকপকেট!
আমি ভাল নেই একদম। ডিপার্টমেন্ট সম্ভবত আমাকে ছাড়বেনা। তাই পরীক্ষার দিন দিচ্ছেনা। এক্সট্রা একটা কোর্স নিয়েছিলাম সেটা নিয়েও বিপদে আছি। কোর্সটা যেমন মজার তেমনি দূর্বোধ্য! ঠিক তোমার মতই। আচ্ছা আমি কীভাবে এত সিরিয়াস হয়ে গেলাম? ভার্সিটি লাইফ কাটিয়েছি আড্ডাবাজি করে। কোর্স টিচার নাম ভুলে গেছে। ক্লাসে বসে থেকেও আমি কক্ষনো হাজিরা দিতাম না। সবাই একঘন্টা আগে হলে ঢুকেছে। আমি পরীক্ষা শেষ হবার একটু আগে, কারন রক্ত দিতে গেছি। পরীক্ষার রিটেক দেয়া যায়। একজন মানুষের জীবনের কোন রিটেক হয়না! জীবন নিয়ে খেলার সাহস সবার থাকেনা। আমার ছিলো। অথচ আমি এখন সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছি কেমন! একগাঁদা বইপত্র কিনে এনেছি বিসিএস পরীক্ষা দেব বলে। অবশ্য একটা কারন দাড় করানো যায়। আমি আমার বাবাকে কিছু দিতে পারিনি। যেদিন শুনেছি আব্বার রিটায়ারমেন্ট চার বছর পরেই। সেদিন থেকেই সিরিয়াস হতে ইচ্ছে হয়েছে। খুবই কনফ্লিকশান হচ্ছে আমার দুই সত্বার সাথে।
আজকাল খুব অর্থকষ্টে আছি। জীবনের এক পর্যায়ে সবারই বোধহয় এরকম হয়। বাবার কাছে টাকা চাইতে ভালোলাগেনা। সামান্য কিছু টাকার জন্য দুচারটে অফিসে ঘন্টার পর ঘন্টা শ্রম দেই। দুটো টিউশনির অফার ছিল। সেটাও না করে দিয়েছি। সব কিছুরই যে একটা বয়স থাকে সেটা স্পষ্ট টের পাই আমি। আজকাল আরো অনেক কিছুই টের পাই। আমরা, ব্যাসিক্যালি আমি। ভীষন আত্নকেন্দ্রিক। তবে ছাপোষা নই একদম। আমি নিজেকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। একটা উদাহরণ দেই। সেদিন ভোররাতে সিগারেট খেতে খেতে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। আমি আয়নায় নিজেকে নিজে দেখে মুগ্ধ হতে লাগলাম। ভোররাতে সিগ্রেট খাওয়া ঠিক হবেনা নিজেকে বুঝিয়ে সিগ্রেট ফেলে দিলাম। এই কাজটা তুমি এবং আমার প্রাক্তন প্রেমিকারা পারেনি!
তুমি ভালো থেকো। খুব দ্রুতই তোমার শহরে আসব। আপাকে বলে কোনরকম শ্যাওলাপড়া একটা ছাঁদ জোগাড় করেছি। তোমাকে নিয়ে সারারাত জ্যোৎস্না দেখবো। তুমি চাইলে কোন এক রাতের ট্রেনে উঠে পড়ব হুট করে সিলেটের উদ্যেশ্যে।
পুনশ্চঃ চিঠিটায় কষ্ট মুড়ে দেওয়া আছে। আজকাল আর কোন ডাকপিয়ন কষ্ট মুড়ে দেওয়া চিঠি বয়ে নিয়ে যায়না। ইথারে ইথারে ছুটে চলা চিকন চুলের সোনালী ডাকপিয়ন তোমাকে বুঝতে দেয়না চিঠির কত বোঝা। সে বোঝে লজিক। ফলস এন্ড ট্রু লজিক। তুমি আমি সত্য। তুমি আছো আমি নেই এটা ভীষণ মিথ্যে। ফলস লজিক। আমাদের খুব লজিক্যাল হওয়া প্রয়োজন।
-রি।
১৩টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
দূর্দান্ত। মন ছুঁয়ে যাবার মতো চিঠি। একেকটি শব্দে সে যে কি গভীর অনুভূতি! জীবনের জটিলতার ভেতরেও সহজ করে সাজিয়ে রাখা ভাবনা, বাস্তবতার মধ্য দিয়ে ছুটে চলা, ভালোবাসা, নিজেকে স্বপ্নের ভেতর মুড়ে দিয়ে, সাথে সাথেই আবার বাস্তব জগতে নিয়ে আসা। ছুঁয়েও না ছোঁয়া, অনেকগুলো কথা না লিখেও বুঝিয়ে দেয়া। চিঠির মতো চিঠি হয়েছে। খুবই ভালো লেগেছে। দারুণ!
তেলাপোকা রোমেন
একটা লাইন ছিল ” অবনী বাড়ি আছো? ” খুবই সাধারন কথা, কিন্তু গভীরতা আছে। আমাদের যাবতীয় বিষয়ে, খুব সাধারন বিষয়ে এমন গভীরতা আছে। আমরা সচেতন ভাবে খুঁজে দেখলে পেয়ে যাই। চিঠিটা আসলে একজনকে লেখা। প্রিয় কাউকে। তাই বাস্তবিক কথাবার্তা উঠে এসেছে।
শুভকামনা রইলো। (3
নীলাঞ্জনা নীলা
সাধারণ কথার ভেতরেই কিন্তু গভীরতা থাকে।
এতো আবেগ মাখা লেখা সেজন্যই, এখন বুঝতে পারছি।
ভালো থাকুন।
শুন্য শুন্যালয়
আমি খুব ঈর্ষা করি যারা কৃত্তিমতা ছাড়াই সহজ স্বাভাবিক লেখাতে তাদের সবটুকু আবেগ ঢেলে দিতে পারে। অসম্ভব সুন্দর একটি লেখা। আপনি শুধু অকবিতা নয়, অচিঠিও অসাধারণ লেখেন।
সবাই যদি আপনার মতো করে নিজেকে ভালোবাসতে পারতো!!
চিঠিটি প্রথম সাড়িতে চলে যাক, শুভকামনা।
তেলাপোকা রোমেন
আপনিও নিজেকে ভালোবাসুন। ধরুন আপনার কাছে নিজের জন্য কোন ভালোবাসা নেই। মানুষকে দিবেন কিভাবে ?
শুভকামনা আপনার জন্য । (3 (3
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
ওস্তাদ মানতে হয় যা লিখলেন তাতে আমি থ -{@
তেলাপোকা রোমেন
😀 শুভকামনা ভ্রাতা। (3 (3 (3
নাজমুল আহসান
আপনি ভালো লিখেন ভাই -{@
এরকম সাবলীল লেখা আজকাল চোখে পড়ে না। সবাই লেখার মধ্যে যাচ্ছেতাই কঠিন আর জটিল শব্দ ঢুকিয়ে নিজেকে পণ্ডিত প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। অথবা তাঁদের উচ্চতর সাহিত্য আমার অ্যান্টেনার উপর দিয়ে যায় -ব্যাপারটা এমনও হতে পারে। যে কারণেই হোক, আমি এসব উচ্চমার্গীয় সাহিত্য থেকে দুরে থাকি।
শুভ কামনা। নিয়মিত লেখা চালিয়ে যান।
তেলাপোকা রোমেন
নিয়মিত লেখালেখি হইয়ে ওঠেনা। কারন আমি দারুন একজন পাঠক। লেখালেখি ঠিক আমার সাথে যায়না। কাউকে উদ্যেশ্য করে কিছু লিখে ব্লগে দিলে সেটা যদি আপনি লেখালেখির অংশ হিসেবে চালিয়ে নিতে পারেন তাহলে খুশি হব।
আপনার জন্যো শুভকামনা। ভালো থাকুন। (3 (3 (3 -{@
চাটিগাঁ থেকে বাহার
চিঠিটি অনেক ভালো হয়েছে।
-{@
আগুন রঙের শিমুল
হলুদ পাতার দীর্ঘশ্বাস 🙂
অনিকেত নন্দিনী
কী আর বলবো? তুই বরাবরই ভালো লিখিস। তোর লেখার আলাদা একটা ধরণ আছে। মনে আছে বছর চারেক আগে একবার ছদ্মনামে ফেসবুক আইডি খুলে আমাকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলি পর কেবল এই লেখার ঢঙের কারণেই তোকে চিনে ফেলেছিলাম?
তেলাপোকা খুব বাজে জিনিস, একদম পছন্দ করিনা কিন্তু ব্লগের এই তেলাপোকার লেখার দারুণ ভক্ত আমি তা অবলীলায় স্বীকার করি, করবো।
লেখালেখিটা ছেড়ে দিসনা, লেগে থাক পাগলা।
বৃষ্টিভেজা মেহগনি ফুলের সুবাসমাখা শুভেচ্ছা তোর জন্য। শুভকামনা রইলো।
মেহেরী তাজ
আপনি ভালো লেখেন ভাইয়া!!!
এভাবে খুব সহজে নিজের কথা বলতে পারা মানুষ দেখলে আমার ভালো লাগে।
ভালো থাকুন।