অনেক কলামিস্টদের মধ্যে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম আমার একজন প্রিয় ব্যাক্তিদের একজন। তিনি লেখার মধ্যে আলাদা আলাদা উপমা বাঁ উক্তি দিয়ে বোঝান। এখানেও তাই। আমার মত অনেকের ভাল লাগবে আশা করি আবার রাজনৈতিক কারনে নাও লাগতে পারে।
এখানে ছোট্ট একটি স্রীতি উল্লেখ করছি। প্রিয় নুরুন্নহার শীরিন আপুর গাড়ীতে মুক্তিযুধ্ব ট্রাস্টিতে অনুদান দিয়ে ফিরছি। শিরিন আপুর সাথে কথোপকথন। এই বীরের কথা তুলতেই আপু বললেন,
শীরিন আপুঃ  আমার নিকট আত্মীয়র একজন এক খেয়েমী।
আমিঃ আপু যায় বলেন না কেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি জা বলতে পারেন আওয়ামিলীগের বড় বড় নেতারা ও প্রতিবাদ করতে পারে না। (সেই সময় বি.এন.পি সঙ্গে বৈঠক সম্ভবত)। আওয়ামীনেতারা গালি খায় কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারেনা। কিন্তু এই বীর সেদিন বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কেউ কটু কথা বলতে পারবেনা। তবেই আপনাদের সঙ্গে বৈঠক হতে পারে।
আজ বাংলাদেশ প্রতিদিনে তাঁর এই কলামটি সবার সঙ্গে শেয়ার করছি।
তিনিই একমাত্র আন্তর্জাতিক নেতা
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম
তিনিই একমাত্র আন্তর্জাতিক নেতা

বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কেন যে বলেছিলেন, ‘আমি যেদিন থাকব না, সেদিন কত বড় বড় সভা হবে, বিশেষণের পর বিশেষণ, বক্তার পর বক্তা, টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পড় মেরে। ’ কত বছর পর গণসংগীতের প্রবাদপুরুষ স্বাধীন বাংলা বেতারের মরমি কণ্ঠ ‘সালাম সালাম হাজার সালাম, সকল শহীদ স্মরণে’-র গায়ক আবদুল জব্বারের বুকফাটা আকুতি, ‘আমার মৃত্যুর পর শহীদ মিনারে নিয়ে গেলে কত শ্রদ্ধা কত ফুলমালা। আমি ওসব চাই না। আমি যে কটা দিন বেঁচে থাকি ভালোভাবে বাঁচতে চাই।   সে জন্য চিকিৎসা দরকার। আমার চিকিৎসার অর্থ নাই। ভিক্ষা চাই না, মর্যাদা চাই। ’

একজন মরমি গায়ক যার অবদানের প্রকৃত স্বীকৃতি দিতে একটা জাতিকে হিমশিম খেতে হবে।   তার শেষ জীবনে এমন আক্ষেপ একটা দেশ ও জাতির জন্য কত দুর্ভাগ্যের, এটাও আজ ভাবার বা উপলব্ধি করার তেমন কেউ নেই। ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে জাতির বিবেক, জাতির স্পন্দনের কাছে আমার প্রার্থনা, এ উপমহাদেশের বিখ্যাত গণসংগীতের দরদি গায়ক আবদুর জব্বার যেন এমন আক্ষেপ নিয়ে না মরেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় নন, একমাত্র আন্তর্জাতিক নেতা বলে কি এমন বেশি বলেছি? সমর্থকরা খুশিতে গুলগুলা, বিরোধীদের যেন মাথায় বাড়ি। কারও কারও ধারণা, আমি সরকারের পক্ষে বলছি। আমি কারও পক্ষে-বিপক্ষে বলিনি, যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি। কেউ যদি চোখ থাকতেও না দেখে তাহলে তাকে দেখাব কী করে? বাংলাদেশে এখন আর কে আছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নেতা? প্রধান বিরোধী দলের জনপ্রিয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অন্য কেউ? না, মোটেই না। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নেতা এরা কেউ নন। ড. কামাল হোসেন? নিশ্চয়ই তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনবিদ, রাজনৈতিক নেতা নন। আরেকজন যিনি সারা বিশ্ব জয় করেছেন। আমরা তাকে অপমান অপদস্ত না করলে আরও হয়তো অনেক কিছু করতে পারতেন। যে যাই বলুন, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এখনো যার আমাদের সবার চেয়ে বিশ্বজোড়া খ্যাতি, তিনি অধ্যাপক ইউনূস। তিনিও রাজনৈতিক নেতা নন। তাকে বাংলার গর্ব, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি বা এক অর্থে তাকেই বাংলাদেশ বলা যেতে পারে। কিন্তু তবু তিনি বাংলাদেশের কোনো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা নন। সে ক্ষেত্রে সত্যি সত্যিই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা অনেক দূর এগিয়ে। কেউ কেউ মনে করেন অযথা যেখানে সেখানে বারবার সফর করে দেশের অর্থ ধ্বংস করছেন। আমরা যদি জয়-পুতুলের মতো ইংরেজিতে লেখাপড়া করতাম অথবা সাবলীল বলতে পারতাম তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশ্ব রাজনীতিতে আরও অনেক উপরে অবস্থান থাকত। এটা তার যোগ্যতা এবং বর্তমানে দেশের আন্তর্জাতিক উচ্চতা দুটোই সমানভাবে প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে আমি কোনো পক্ষপাত করিনি। আমি কাউকে অযথা ছোট করি না, নীতি থেকে সরি না—এটা আমার দোষও হতে পারে, গুণও হতে পারে। আমার সকাল-বিকাল সারা জীবন এক ও অভিন্ন। কারও সঙ্গে কোনো কথা দিলে দলিল দস্তাবেজের প্রয়োজন পড়ে না, জীবন দিয়ে কথা রাখি। আমার কোনো সাক্ষী লাগে না, দয়ালু আল্লাহ-ই আমার ভালো সাক্ষী। এটা আমার স্বভাব। এ স্বভাবে ভর করে এতটা পথ এসেছি। আর পথের বাকিই-বা কত? যেটুকু বাকি সেটুকু আলী আলী বলে তরতর চলে যাব।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে শুধু জাতীয় নেতা না বলে বর্তমানে দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক নেতা বলে কোথাও কোনো তিলমাত্র ভুল করেছি বলে মনে হয় না। আমার মনে হয় জননেত্রী শেখ হাসিনা শক্তিশালী দলীয় নেতা—জাতীয় প্রশ্নেই বরং কিছুটা সন্দেহ, কিছুটা দ্বিধা আছে। বিএনপির কোনো লোক জননেত্রীকে কোনো বিচার-আচারে বিশ্বাস করবে? করবে না। তেমনি বেগম খালেদা জিয়াকেও আওয়ামী লীগের কোনো লোক আস্থায় নেবেন না। তাহলে তারা দলের ঊর্ধ্বে জাতির কী করে হলেন বা হবেন? আমরা আস্থার অভাবে ভুগছি। যেভাবেই হোক এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। স্বাধীনতার আগে মুসলিম লীগের লোকজন ছিল সমাজপতি, নেতা। টাঙ্গাইলের জনাব ফজলুর রহমান খান ফারুকের চাচা জনাব জলিল মিয়ার কাছে বিচার দিতে আমাদের কোনো সন্দেহ হতো না। মুসলিম লীগের বিপক্ষে মুসলিম লীগের নেতার কাছে বিচার দিয়ে আমরা ন্যায়বিচার আশা করতাম এবং পেতাম। কিন্তু এখন সে অবস্থা নেই। জাতীয় সমস্যায় শেষ পর্যন্ত সবাই মিলে কোথাও যেতে পারি এমন জায়গা না থাকায় এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সময় থাকতে এখান থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা খোঁজা উচিত। ব্রিটিশ আমলে কথা ছিল বাঙালি আজ যা ভাবে সারা ভারত ভাবে পরদিন। আর বিশ্বভাবে আরও একদিন পর। সেই বাঙালি সেই জাতি জ্ঞানে-বিজ্ঞানে আরও কত অগ্রসর হয়েছে। তারপরও কেন সামনে দেখতে পাচ্ছি না বা সামনের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক হচ্ছি না? দেশ ধ্বংস হলে আমাদের অবস্থান কী হবে? দেশ না থাকলে আমরা কোথায় থাকব? রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী কোথায় থাকবেন? কোথায় থাকবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি?

ক’বছর আর হবে, চার-পাঁচশ বছর আগের কথা। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি যেদিন ১৭ জন ঘোড় সওয়ার নিয়ে বাংলা জয় করেছিলেন। তেমন যদি আবার কখনো হয়। ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি গজনী বা ঘোর থেকে এসে ভারত বা বাংলা দখল বা জয় করেনি। তখন ভারতে মুসলিম শাসন ছিল। বাংলায় ছিল হিন্দু শাসন। বাংলার রাজধানী ছিল কলকাতা বর্ধমানের মাঝামাঝি গৌড়। তিনি ১২০৪-১২০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গ জয় বা বাংলায় মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করেন। কদাকায়, বেঁটে-খাটো বখতিয়ার খিলজি আফগানিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। জাতিতে তুর্কি, বংশে খিলজি। ভাগ্যের অন্বেষণে কর্মের সংস্থানে বহুদিন মারা মারা ফিরে এক সময় গজনীতে গিয়ে শাহাবুদ্দিন ঘুরির কাছে চাকরি প্রার্থনা করে ব্যর্থ হন। সেখান থেকে বাদায়ুনের শাসনকর্তা হিজবত উদ্দিনের কাছে যান। মালিক হিজবত উদ্দিন নগদ বেতনে তাকে একটা ছোট্ট চাকরি দেন। কিছ ুদিন সেখানে থেকে বখতিয়ার খিলজি বাদায়ুন থেকে অযোধ্যায় যান। অযোধ্যার শাসনকর্তা হুসাম উদ্দিন তাকে মধ্য প্রদেশের মির্জাপুর জেলার ভগবৎ ও ভিউলি পরগনা জায়গির দেন। বখতিয়ার খিলজি ছিলেন খুবই পরিশ্রমী কর্মঠ দৃঢ়চেতা। তিনি আশেপাশের ছোটখাটো রাজ্যগুলো দখল করে অল্প দিনে দারুণ শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। ভাগ্যের অন্বেষণে দেশত্যাগী অনেক মুসলমান সৈন্যকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে তেজী এক শক্তিশালী সেনাদল গড়ে তোলেন। এরপর বিহারে এক বিস্ময়কর অভিযান চালিয়ে সফল হন। তখন বাংলায় সেন বংশের শাসন। লক্ষণ সেন গৌড়ের রাজা। নদীয়া ছিল গৌড়ের দ্বিতীয় রাজধানী। বখতিয়ার খিলজি বঙ্গ বিজয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিহার থেকে সমতলের পথে না এসে জার্মান বাহিনীর আল্পস পর্বতমালা জয়ের মতো বিহার থেকে ঝাড়খন্ডের দুর্গম পাহাড়, পর্বত, জঙ্গল পেরিয়ে নদীয়ায় বা নবদ্বীপে আসেন। নদীয়ার জঙ্গলে পৌঁছলে রাত শেষ হয়ে যায়। সেখানে অপেক্ষা না করে তিনি নদীয়া থেকে ২০ মাইল দূরের গৌড়ের পথে ধাবিত হন। পাহাড় পর্বত পেরিয়ে আসতে বখতিয়ার খিলজির মূল দল পেছনে পড়ে যায়। তিনি যখন গৌড়ের সিংহদ্বারে তখন তার সঙ্গে মাত্র ১৭ জন ঘোড় সওয়ার। হাতে কোনো খোলা তলোয়ার ছিল না। লোকরা তাদের তুর্কি ব্যবসায়ী মনে করে হাসিমুখে বরণ করেছিল। প্রাসাদের সিংহদ্বারে যখন বখতিয়ার খিলজি পৌঁছান, তখন লক্ষণ সেনের সেদিনের সভা শেষ। সবাই বাড়ি ফিরে মধ্যহ্নভোজের আয়োজনে ব্যস্ত। রাজাও ভোজের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। বখতিয়ার খিলজি কোনো বিলম্ব না করে সিংহদ্বার দখল করে প্রাসাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। দু-একজন কচুকাটা হলেও এক আমল থেকে আরেক আমলে যেতে যে শক্তি ও রক্তারক্তি হয় তার কিছুই সেদিন হয়নি। গৌড়ের রাজা লক্ষণ সেন পরিবার-পরিজন এবং যতটা সম্ভব ধনসম্পদ নিয়ে প্রাসাদের পেছনের গুপ্তপথে বিক্রমপুরে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

কথাটা বললাম এ জন্য যে, অনেক সময় নানা বিচিত্র ঘটনা ঘটে। সেটা সময়ই বলতে পারে, অন্য কেউ পারে না। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধও তেমন একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল সেটাও খুব একটা আলাদা কিছু ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ করেছি সত্য, কিন্তু আমার কাছে রক্তারক্তি মূল্যহীন। লাখো সৈন্য হত্যা করে যে সেনাপতি যুদ্ধ জয় করে তার চেয়ে লাখো সৈন্য অকেজো করে বিনা রক্তপাত অথবা কম রক্তপাতে যে জয় করতে পারে তাকে আমি বেশি মূল্য দিই। শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে শত্রু সৈন্যের বিপুল গোলাবারুদ অস্ত্রশস্ত্র থাকতেও যে সেনাপতি তাদের সব অকেজো করে দিতে পারে সেই প্রকৃত যুদ্ধের নেতা। যেটা আমরা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে করেছি বা করতে পেরেছি। আমাদের মোকাবিলা করতে হানাদার পাকিস্তান যে বিপুল অস্ত্র একত্র করেছিল শেষের দিকে তার দশ ভাগের এক ভাগও ব্যবহার হলে ২০-২৫ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য এবং আমাদের আরও কয়েক লাখ যোদ্ধা ও অগণিত দেশবাসী এবং বিপুল সম্পদের ক্ষতি হতো। কয়েকশ বছরের পুরনো ঢাকা বোমার আঘাতে মাটিতে মিলিয়ে যেত। কিন্তু আমরা তা হতে দেইনি। পাকিস্তানিরা যত দাপটই দেখাক শেষ পর্যন্ত গুলি ছোড়ারও সুযোগ পায়নি।

আমার ভয় আমলা ফইলাদের বিশ্বাস করে যারা দাপট দেখাচ্ছেন, হাত গুটালে তাদের কী হবে? আমি চাই সুস্থ রাজনীতি এবং রাজনৈতিক ভারসাম্য। সে জন্য অন্তর থেকে উৎসারিত জনগণের কান্না ব্যক্ত করার চেষ্টা করি। আমি কারও পক্ষে-বিপক্ষে নই। আমি অনেক সময় নিজের পক্ষেই নয়। আগে বিদ্যা ছিল না, বুদ্ধি ছিল না, জ্ঞানের কোনো স্পর্শ ছিল না। আত্মার নির্দেশে যখন যা পাই তা থেকে সরানোর শক্তি দুনিয়ার কারও নেই। তাই সাহস করে বলি, পরম দয়ালু আল্লাহ আমার চেয়ে আর কাকে বেশি দিয়েছেন। বাউণ্ডুলে বাঁধন ছাড়া একেবারে অপদার্থদের একজন ছিলাম আমি। আর কিছু না হোক নিজের সঙ্গে নিজে যাতে অন্যায় না করি সে চেতনা তো আমার দয়ালু আল্লাহ আমায় দিয়েছেন। আল্লাহ কাউকে কোনো চেতনা না দিলে সে তা অর্জন করতে পারে না। সূরা বাকারার ২৫৫ নম্বর আয়াত, যাকে আমরা আয়তুল কুরসি বলি, সেখানে মহামহিম রব দয়াময় প্রভু স্পষ্ট করে বলেছেন, তিনি কোনো জ্ঞান না দিলে কেউ জ্ঞানী হতে পারে না। তাহলে আমার উপলব্ধি তিনি না দিলে পেতাম কোথায়? নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই সেটা অন্যায়, আর পক্ষে হলে ন্যায়— এটা যে সত্য নয় এ উপলব্ধিই তো আমাদের অনেকের নেই। নিজের সংসার টিকিয়ে রাখতে ছোটখাটো কারণে মেয়েদের কায়েমি স্বার্থী হতে আল্লাহই ক্ষমতা দিয়েছেন, পুরুষকে অমনটা দেননি এটা তাঁর সৃষ্টির কৌশল। তাই জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক নেতা বলে খুব বেশি কিছু করেছি বা বিরোধীদের মাথায় বাড়ি দিয়েছি তেমন নয়।

এ সেদিনের ছোট্ট একটা কথা। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে সৌদি আরবে ‘আরব ইসলামিক আমেরিকান সামিট’ হয়ে গেল। ইরানকে বাদ দিয়ে ৫৬-৫৭টি মুসলিম দেশ তাতে অংশ নিয়েছিল। ট্রাম্পের কয়েক মাস আগের মুসলিম নীতির সম্মেলনে কিছুটা বদল দেখা গেছে। পরে কতটা কী হবে তা পরের কথা। কিন্তু যেটা হয়েছে সেটা হলো, সেই সম্মেলনে একমাত্র মহিলা প্রতিনিধি ছিলেন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ কোনো মুসলিম রাষ্ট্র নয়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। পাকিস্তানকে কিন্তু আমন্ত্রণ জানানো হয়নি— এটাই জননেত্রীর সাফল্য। অতগুলো পুরুষের মধ্যে একজন মহিলা আমাদের নেত্রীর কি অস্বস্তি লাগেনি, নাকি ৫৬-৫৭ জন রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধান অস্বস্তিবোধ করেছেন? অত বড় সম্মেলনে একজন মহিলা। এটা শেখ হাসিনার রাজনীতির ফল, দেশের উচ্চতা। স্বাধীনতার পরপর দিল্লিতে একবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং আমায় দাওয়াত করেছিলেন। কম বয়সী ছিলাম। মন্ত্রী ও নেতাদের মধ্যে খাওয়ার টেবিলে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেবিনেটে আপনারা সবাই পুরুষ, ইন্দিরাজি একা মহিলা। তিনি অস্বস্তিবোধ করেন না? শরণ সিং ছিলেন কাশ্মীরের মানুষ। খুব আমোদে স্বভাবের। হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘আরে টাইগার, আমাদের কেবিনেটে ওই একজনই পুরুষ। আর আমরা সব মহিলা। ’ বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কি তেমন বলা চলে?

সংবাদপত্রের প্রধান কাজ সমাজের ওপর দৃষ্টি রাখা। কোনো অন্যায় অবহেলা দেশ ও সমাজের চোখে তুলে ধরা। এ ক্ষেত্রে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছিলেন সংবাদপত্রের পথপ্রদর্শক এক মহান পথিকৃৎ। গণমাধ্যম সচল থাকলে, গণমাধ্যম সক্রিয় থাকলে সমাজ আপনাআপনিই অনেকটা নিরাপদ গতিময় থাকে। মাত্র দুই মাস আগে বাংলাদেশ প্রতিদিনের ফরিদপুরের প্রতিনিধি কামরুজ্জামান সোহেলের খবরে মধুখালীর বেসদী গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানকার এমপি আমাদের নেতা মির্জা তোফাজ্জল হোসেন মুকুল ভাইর মেয়ে, ভাগ্নি বন্যার স্বামী মো. আবদুর রহমান। প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ মোহাম্মদ আবু জাফরের বাড়িও সেখানে। সরেজমিন দেখলাম, জহুরা বেগম এবং তার স্বামী পাচু সরদারের থাকা-খাওয়ার খুব একটা কষ্ট নয়, তাদের কষ্ট সন্তানের অবহেলা এবং প্রতারণা। আমার মনে হয়েছিল খবরটি দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে বাংলাদেশ প্রতিদিন দেশের জন্য শ্রেষ্ঠ অবদান রেখেছে। ঠিক তেমনি গফরগাঁওয়ের এম এ হাশেমকে অন্ধকার থেকে আলোয় এনে আমাদের সময়ের প্রাণপুরুষ মোহা. নূর আলী সমাজ ও দেশের জন্য শ্রেষ্ঠ অবদান রাখলেন। বড় ব্যবসায়ী। তিনি হয়তো ব্যবসা করে হাজার কোটি অর্জন করতে পারেন, কিন্তু দু-দুবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য, স্বাধীনতা সংগ্রামী, বঙ্গবন্ধুর সহচর প্রবীণ নেতা এম এ হাশেমকে অবহেলার অন্ধকার থেকে আলোয় এনে তিনি তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি লাভবান হয়েছেন। বেলা তলিয়ে গেলে আমরা খুব একটা দিনের কথা মনে রাখি না, নতুন দিনের আশায় থাকি। তার কোনো ভূমিকা স্বীকার না করেও শুধু খুনিদের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর খোন্দকার মোশতাক তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতির জন্য বঙ্গভবনে সংসদ সদস্যদের যে সভা আহ্বান করেছিলেন, সংসদ সদস্যদের বাসে ‘জয় বাংলা জয় বাংলা, বঙ্গবন্ধুর খুুনিদের ফাঁসি চাই, কল্লা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে এম এ হাশেম ও অন্যরা বঙ্গভবনে ঢুকেছিলেন। খুনিরা হাশেমের বুকে অস্ত্র ধরলেও তার কণ্ঠ থেকে সে দিন বঙ্গবন্ধুর নাম ছিনিয়ে নিতে পারেনি। সভা শুরু হলে অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক খোন্দকার মোশতাককে খুনি বলে তিরস্কার করে প্রেসিডেন্ট হিসেবে অস্বীকার করেছিলেন। সেদিন তাকে সমর্থন করেছিলেন ঠ্যাঙ্গারবান্দের শামসুল হক ও কালীগঞ্জের ময়েজ উদ্দিন, যাকে এরশাদের সময় হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু বিচার হয়নি। ’৭৫-এ যিনি বঙ্গভবনে ওভাবে মোশতাকের মুখোমুখি খুনি বলেছিলেন, নব্বইয়ের গণআন্দোলনে এরশাদের পতনের পর উকিল হিসেবে স্বৈরাচার এরশাদের পাশে দাঁড়ানোয় অ্যাডভোকেট সিরাজুল হককে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করতে দেওয়া হয়নি, বহিষ্কার করা হয়েছিল। গুলশানে মাননীয় মন্ত্রী আমির হোসেন আমুর পরিত্যক্ত বাড়িতে সে মিটিংয়ে আমিও ছিলাম। আমাদের অনেকের মত ছিল না। এমনকি সভানেত্রীরও না। কয়েকজন তরুণ তুর্কির প্রচণ্ড চাপে সেদিন সভানেত্রী শেখ হাসিনা সিরাজুল হকের বহিষ্কারের সিদ্ধান্তে মত দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের ছায়া, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম শুধু পাকিস্তান অ্যাম্বাসিতে দাওয়াতে যাওয়ায় এবং যেখানে খুনি ডালিম-ফারুকদের কেউ উপস্থিত থাকায় তাকেও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, স্বৈরাচার আজ আমের আচার হয়ে আওয়ামী লীগের মাথায় চেপে বসেছে—কারও কোনো আকার-বিকার নেই। পাকিস্তান অ্যাম্বাসির দাওয়াত খেতে যাওয়ায় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বহিষ্কৃত হয়েছিলেন।   অথচ আজকাল আওয়ামী লীগে পাকিস্তানের কত এজেন্ট। তাই না বলে পারছি না, সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়।          লেখক : রাজনীতিক।

 

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ