আমি তখন ক্লাস ফোরের ছাত্র আর শর্মি ক্লাস সিক্সে। এই বয়সে আমার ছোটবেলার খেলার সাথী আমার জীবন থেকে হারিয়ে যায়। ১৯৭১ এর এপ্রিল মাসের ২৭ তারিখে আমাদের ছোট্ট শহরটিতে পাক সেনারা আসে এবং আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় প্রায় ৮০% বাড়িঘরে। আমাদের আমার মানিক মামার পরিবার একসাথে আমাদের গ্রামের বাড়ি চলে যাই। মে মাসের শেষ পর্যন্ত একসাথেই থাকি আমরা। এরপর আমাদের দুই পরিবারের চোখের পানির বন্যায় বাঁচার তাগিদে বিচ্ছিন্ন হই। একেবারেই হারিয়ে যায় মানিক মামার পরিবার, আমার শর্মি।
স্মৃতি ব্যংকে জমানো স্মৃতি থেকেঃ
তখন আমি ক্লাস টু এর ছাত্র, আমাদের বাসায় ভাড়াটিয়া হয়ে আসেন মানিক মামা এবং তার পরিবার। মানিক মামার বড় মেয়ে সারমিন। যাকে সবাই শর্মি ডাকতো, শর্মি তখন ক্লাস ফোরে। ভাড়াটিয়া হলেও মিলেমিসে একটি পরিবার হয়ে যাই আমরা। শর্মির সাথে আমার বন্ধুত্ব তখনই শুরু। আমি ছোট বলে তাকে মানতাম খুব। পুতুল খেলা, রান্নাবারি খেলা দুজনে একই সাথে। স্কুলের সময়ের পরে প্রায় সারাক্ষন দুজনে একসাথে। আমি ছিলাম শর্মির বউ আর সে ছিল আমার বর। এ সম্পর্ক শর্মিই নির্ধারন করে দিয়েছিল। রান্না বান্না খেলায় আমি ভুল করলে শর্মি আমাকে মারতো। মেরে বলতো বউকে মাঝে মাঝে পিটাতে হয়, পিটানোর পরে আবার আদর করতে হয়। এমন কোন দিন ছিলনা যেদিন আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে দুই বেলা খাবার দাবার আদান প্রদান না হতো। আমার বাসা থেকে আম্মা বলতেন’ এই নে তোর জামাইকে দিয়ে আয়’। শর্মির বাসা থেকে শর্মিকে বলতো’ তোর বউকে দিয়ে আয়’।
একদিন মানিক মামা কোথা থেকে জানি কাঠ বাদাম নিয়ে আসলেন। এর মধ্যে থেকে চার পাছটা বাদাম নিয়ে দৌরে আমার কাছে চলে আসলো শর্মি।
= বঊ বটি নিয়ে আয়, আমি তোকে বাদাম কেটে খাওয়াই।
আমিও আনন্দে নাচতে নাচতে বটি নিয়ে আসি। একটি বাদাম আমি আছি আর শর্মি দিল বটি দিয়ে বাদামের উপর কোপ। বাদাম কাটলো সাথে আমার বাম হাতের তর্জনির একটি করও কেটে আলাদা হয়ে গেলো। রক্ত দেখে চিতকার করে উঠলো শর্মি নিজেই। আমি তখন বোকার মত বাদাম, আংগুলের কাটা অংশ, আর শর্মির মুখের দিকে তাকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। শর্মির চিতকারে আম্মা, মামি সবাই এসে আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে। কাটা অংশ আর জোড়া লাগেনি। শর্মি রাত দিন আমার পাশে বসে থাকতো আর ব্যান্ডেজ করা আঙুলের দিকে তাকিয়ে চোখের পানিতে গাল ভেজাত। এই শর্মিকে আমি হারিয়ে ফেলি ৭১ এর মে মাসে। আমার অন্তরের অন্তস্থলে থাকা বন্ধু, যাকে খুঁজেছি আমি।
২০১৩ সনের মে মাসের এই দিনে একজন সারমিন এর বন্ধু হই আমি। আমাদের বন্ধুত্বের আজ চার বছর পূর্তি। সময়ের পরিক্রমায় আজ তিনি আমার সেরা বন্ধুদের অন্যতম। দূরত্ব এবং সময়ের ব্যবধান আমাদের বন্ধুত্বের নৈকট্যের বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। যিনি আমাকে বোঝেন, যাকে আমি বুঝি। তার তুলনা কেবল তিনিই হতে পারেন।
আস্থায়, নির্ভরতায়, শ্রদ্ধায়, ভালবাসায় তার মত কেউ নেই।
২৬টি মন্তব্য
সঞ্জয় কুমার
স্মৃতিময় মধুর ছেলেবেলার গল্প । মাঝে মাঝে সেই সব স্বর্ণালী দিন গুলোতে ফিরে যেতে মন চায় ।
জিসান শা ইকরাম
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
নীহারিকা
অঙ্গুল কাটার কি ভয়ংকর একটি ঘটনা বললেন এখানে। আচ্ছা, এটা কি সত্যিই আপনার হাতের ঘটনা? নাকি গল্প? বেশ কনফিউজড হয়ে গেলাম। তবে বার বার বন্ধু হারানো কিন্ত ঠিক নয়। আর জীবনে ভালো একজন বন্ধু থাকা খুব জরুরী যারা একে অপরকে বুঝতে পারেন। সেদিক দিয়ে আপনি খুবই ভাগ্যবান যে এমন বন্ধুর দেখা পেয়েছেন। আপনাদের বন্ধুত্ব অটূট থাকুক। কোনো ঝড়-ঝঞ্ঝায় যেন এ সম্পর্কে ফাটল না ধরে এই কামনা করছি। দুজনের জন্যই অনেক অনেক শুভকামনা।
জিসান শা ইকরাম
এটি সত্যি ঘটনা। গল্প হলে তো গল্প বিভাগ দিতাম।
গভীর ভাবে লক্ষ্য করলে বুঝা যায়, নখের অর্ধেক লম্বালম্বি ভাবে আলাদা হয়ে গিয়েছিল।
হ্যা আমি অবশ্যই ভাগ্যবান যে শুন্য শুন্যালয়ের মত এমন একজন বন্ধু পেয়েছি, যার আসল নামও সারমিন।
শুভকামনার জন্য ধন্যবাদ।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
মহান মুক্তিযুদ্ধে আপনার এমন বন্ধুর বিয়োগেই হয়তো এ স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি।যেখানে থাকুক সে ভাল থাকুক সে এই কাম্য।আর ২০১৩ সালের বন্ধুটি আমাদরও অনেক প্রিয় সব আপনার উসিলায় তাই কামনা করছি বেচে থাকুন আপনারা যুগ যুগ ধরে।লেখায় ভাল লাগা জানিয়ে গেলাম -{@
জিসান শা ইকরাম
ধন্যবাদ মনির ভাই।
শুভ কামনা।
ইঞ্জা
ভাইজান, জীবনে এমন কিছু বন্ধু আছে, যাদের ভুলা যায়না, আপনার বন্ধু যেখানেই থাকুক, আল্লাহ্ উনার পাশে থাকবেন আর নতুন বন্ধুকে দিন আপনার আস্থা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, এই তো জীবনের নিয়ম, শুভকামনা।
জিসান শা ইকরাম
শুভকামনার জন্য ধন্যবাদ ভাই।
আপনার জন্যও শুভ কামনা।
ইঞ্জা
(3 -{@
জিসান শা ইকরাম
-{@
মৌনতা রিতু
এমন বন্ধু পাওয়া মুশকিল। আপনাদের এমন বন্ধুত্বে সত্যিই শ্রদ্ধা জানাতে ইচ্ছে করছে।
মাঝে বউকে পিটাতে হয়! এমন বউপুতুল খেলার আর সময় ও সেই মিষ্টি সম্পর্কগুলো আর নেই। নেই সেই কৈশোরের নির্মলতা। ভাল লাগলো ভাইয়া।
জিসান শা ইকরাম
ধন্যবাদ তোমাকে প্রিয় ব্লগার।
শুভ কামনা।
আবু খায়ের আনিছ
আহা! কত মধুর সেই শৈশব। এমন হাজারো বাচ্চার হারানো শৈশবের বিনিময়েই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। শ্রদ্ধা তাদের প্রতি।
শুন্য আপু একজন ভালো বন্ধু বটে, আবার বড় বোন বা ভাই দুটোই।
জিসান শা ইকরাম
হ্যা শুন্য শুন্যালয়ের তুলনা কেবলমাত্র তার সাথেই।
ধন্যবাদ আনিছ,
শুভ কামনা।
নীলাঞ্জনা নীলা
শুন্য আপুর মতো ভালো বন্ধু পাওয়া অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। বন্ধুত্ত্বের বর্ষবরণ, কেমন হয় এই শব্দ দুটো?
আর শর্মী আপুকে আবার তুমি ফিরে পাও এই কামনা করি। আমার প্রবাসী বন্ধু লানাকে নিয়ে লিখেছিলাম, মনে আছে? ওর ছবি পেয়েছি, এই দেখো লিঙ্ক দিলাম।
https://www.sonelablog.com/%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8-%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A5%E0%A6%AE-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A7%87/
আর তোমার বুঝি আঙ্গুল কাটা? জানো নানা আমার ভাই রানাকে দেখেছো না? ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে ওরও আঙ্গুল কেটে দিয়েছিলাম। ইচ্ছে করে নয় কিন্তু! কী যে কেঁদেছিলাম! ওর আঙুলে এখনও দাগ আছে। আমাকে বলবে “তুই আমায় কোপাইছিলি নীলা।”
খুব ভালো লাগলো লেখাটা। নিজের জীবনেরও অনেক কথা মনে পড়ে গেলো। ভালো থেকো নানা।
জিসান শা ইকরাম
বন্ধুত্ত্বের বর্ষবরণ বেশ ভালই হয় 🙂 শুভ হোক বন্ধুত্ত্বের বর্ষবরণ।
তোর প্রবাসী বন্ধুর কথা মনে আছে, লেখাটি আবার পড়তে হবে। ছবি দেখলাম, খুবই সুন্দর দেখতে লানা।
একটি কড়ের অর্ধেক চলে গিয়েছিল, এখন অবশ্য গভীর ভাবে না দেখলে বুঝা যায় না।
তুইও ভাল থাকিস প্রবাসে।
নীলাঞ্জনা নীলা
নানা আবার দেখা হলে দেখিও তো! আচ্ছা দেশে যদি আবার কখনও যাই, আসবে শমশেরনগরে?
ছাইরাছ হেলাল
আপনি-তো দেখছি বিশাল ভাগ্যবান (লেখায়)।
সে-তো বিশাল কবি-ছবিয়াল, সেই এক-পিসের সখ্যতা আপনি পেয়ে ভাগ্যবান ভাবতেই পারেন!!
ওহ, এই তাহেলে সারমিনা!!
আপনার দাঁতের চিকিৎসা হয়ে যাবে এবার।
জিসান শা ইকরাম
হুম, বিশাল ভাগ্যবান তো বটেই 🙂
ইনিও একজন সারমিন, যিনি চার বছর আগে আমার বন্ধু হয়েছেন।
দাঁতই তো নাই বলতে গেলে, তার আবার চিকিৎসা!
মিষ্টি জিন
ছোট বেলার বউ জামাই খেলা কতই না মধুর ছিল। খেলার ছলে যেভাবে আংগুল কেটেছে ভাবতেই ভয় লাগছে। দোয়া করি বাল্য বান্ধুকে ফিরে পান।
আমার দেখা স্বার্থভরা এই পৃথিবীতে স্বাথ ছাডা কোন বন্ধুত্ব হয় না। স্বাথ ছাডা কেই এক পা এগোয় না। কেউই না। সেখানে বলবো আপনি এবং আপনার শারমিন বন্ধু দুজনেই বেশ ভাগ্যবান । এমন নি:স্বার্থ বন্ধুত্ব মেলা ভার। বন্ধুত্বের বরষ বরণে দুজনকে শুভেচ্ছা।
অটুট থাকুক বন্ধুত্ব আস্হায় , শ্রদ্ধায় ,ভালেবাসায়।
জিসান শা ইকরাম
ছোট বেলার খেলার সাথীদের আসলে ভোলা যায় না, দু একজন ভিতরে থেকে যান আমৃত্যু।
এমন শুভকামনার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
মোঃ মজিবর রহমান
বন্ধু বন্ধুই তাঁর তুলনা সেই। আহা! এমন বন্ধত্ব আমি জড়াতে পারিনি কাউকে, এটা আমার ব্যারথতা।
ভাল থাকুন, ভাল থাকুন আপনার নতুন শামিন আপু/ শুন্য আপু।
জানতাম সৃতি অতল গহীনে হারায় আপনার পোষ্টে জানলাম জেগে কথা কয়।
কেমন আছে ভাইয়া। দেখা করতে ইচ্ছে করে কিন্তু পারিনা।
লীলাবতী
শুন্য আপুর মত কেউ নেই এ আবার নতুন কি? নেইই তো তার মত কেউ 🙂 আপনাদের বন্ধুত্ব বেঁচে থাকুক যুগ যুগ ধরে।
মায়াবতী
ভাইয়া ছোটবেলার প্রেম বোধ হয় খুব পবিত্র হয় তাই না…. এই জন্য ই আপনি বহু দিন পরে আবার ও সেই সময়ে ফিরে গেছেন এত দিন পার করে দেওয়ার পর ও…. ইথার এর মত মনের টানে মানুষ এক জন আরেক জন কে খুঁজে পায়….
শুন্য শুন্যালয়
আপনাকে বউ বলে ডাকতো? হি হি, মনে আছে কিন্তু কে যেন ছোটবেলায় মেয়েদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিল? আহা সেই দস্যু মেয়েটার নাম যেন কী ছিলো? কুন্তলা না কি যেন!
ছোটবেলার বন্ধুত্বগুলো কতোই না নিষ্পাপ ছিলো, তার সাথে কিছুরই যেন তুলনা হয়না। আপনি দেখি পেয়েই গেছেন আবার তাকে। কী লিংক দিলেন, কাজ করেনা ক্যান? কে এই শারমিন? 🙂
কারো মতোই কি কেউ হয়? আপনার মতোও তো কেউ হতে পারবেনা, চাইলেও নয়। আবেগী, শ্রদ্ধাস্পদ বন্ধুকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি অসাধারন এই সম্মান দেবার জন্য।
আপনার সেই বরটাকেও ফিরে পান আবার, তবে কিছু মানুষ, চরিত্র স্মৃতিতে বেশি সজীব থাকে। তাকে বদলে না দেয়াই ভালো।
ভালো থাকুন অনেক সবসময়। (3 -{@
নীরা সাদীয়া
বেশ ভাল লাগল আপনার এ স্মৃতিচারণ। আপনার স্মৃতিচারণের ফলে আমার ছোটবেলার বন্ধু তামান্নার কথা মনে পড়ে গেল। তাকে নিয়েও লিখব একদিন।