তারচেয়েও সুন্দর এই দেশ

রিমি রুম্মান ২২ নভেম্বর ২০১৬, মঙ্গলবার, ০১:৩৮:২৯অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২৩ মন্তব্য

ঋতু পরিবর্তনের সময়গুলোতে এই শহরে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে।

কেউ এলার্জি জনিত, কেউবা ঠাণ্ডাজনিত, নয়তো শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগে। আমার ছোট বাপজান রিহানও তেমনি অসুস্থ হয় গত সপ্তাহে। কাশি বেড়ে শেষরাতের দিকে শ্বাসকষ্ট। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণত যতো রাতই হোক না কেন, হাসপাতালে ছুটে যাই। জরুরি চিকিৎসা শেষে সুস্থ হলেই ফিরে আসি। সন্তানের অসুস্থতায় কখনো কখনো মায়েরা দিশেহারা হয়ে উঠেন কিংবা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে ভুল করেন, আমারও তা-ই হয়েছে এবার।

সকালের দিকে রিহানের শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো যখন, আমি ছুটলাম ডাক্তারের চেম্বারের উদ্দেশ্যে। সপ্তাহের নির্দিষ্ট কিছু কয়েকটি দিন কাছের অফিসে বসলেও সেদিন ডাক্তার বসেছেন দূরের অফিসে, যেখানে আগে একাকি যাওয়া হয়নি আমার। গাড়িতে জিপিএস সেট করে ছুটলাম। যেতে হবে যতো দ্রুত সম্ভব। এদিকে জিপিএস দেখাচ্ছে অমুক রাস্তায় কন্সট্রাকশন, তমুক রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম, ঘুরে যেতে হবে অন্য রাস্তা হয়ে। তবুও শেষ অবধি পৌঁছালাম যখন, ততোক্ষণে রিহানের শ্বাস ভারী হয়ে আসছিলো। হন্যে হয়ে পার্কিং খুঁজছি আর পিছনের সিটে বসা রিহানকে লুকিং গ্লাসে খেয়াল রাখছিলাম। ছয় বছর বয়সের ছোট্ট মানুষটি কি অসীম ধৈর্যে কষ্ট চেপে নিচু স্বরে কাঁদছে আর টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে ! আমি সান্ত্বনা দেই। বলি, রিহান, এইতো চলে এসেছি আমরা, ডাক্তার ওষুধ দিলেই তুমি ভালো হয়ে যাবা। তিরিশ মিনিট পর গাড়িটি পার্ক করে তাঁকে নামাতে গিয়ে দেখি সে আর দাঁড়াতে পারছে না। কোলে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে যাচ্ছি। একটি মাত্র স্ট্রীট ! যেন মাইলের পর মাইল দৌড়াচ্ছি। দীর্ঘতম এক পথ ! অসুস্থ সন্তান কোলে এক মায়ের কি ভীষণ অসহায় ছুটে চলা ! চেম্বারে ঢুকতেই ডাক্তার হার্টবিট, প্রেসার, শরীরে অক্সিজেনের পরিমাপ দেখতে দেখতে ৯১১ কল করছে। এদেশে ৯১১ ইমারজেন্সী নাম্বার। নাম্বারটিতে ফোন করলে মুহূর্তেই এ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির। সেটিতে টুকটাক প্রাথমিক চিকিৎসার সারঞ্জামাদি থাকে। নাকে অক্সিজেন দিতে দিতে এ্যাম্বুলেন্সেই হাসপাতালে পৌঁছালাম। মুহূর্তেই ডাক্তার, নার্স সকলের ছুটাছুটি, রিহানের মুখে নেবুলাইজার মাস্ক, নাকে অক্সিজেন সহ পুরো শরীর ছেয়ে গেলো নানান রকম নল আর তারে।আমি হেল্‌থ ইনস্যুরেন্স সংক্রান্ত তথ্য সহ, অন্যান্য কাগজপত্রে সাইন শেষে রিহানের পাশে এসে দাঁড়াই। দেখি, ভীষণ ক্লান্ত শ্রান্ত ছোট্ট মানুষটি কি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

রিহানকে কেবিনে দেয়া হোল। রুম নাম্বার ৪১২৭। দরজায় ঢুকতেই দৃষ্টি আটকে থাকে ডানপাশে দেয়ালে ছোট্ট হাতে আঁকা একটি বাঁধাই করে টানানো ছবিতে। বিগত দিনে এই রুমে সেবা নেওয়া রিহানের মতোই ছোট্ট কোন এক রোগী যাবার সময় কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লিখে রেখে গেছে__ Thank you for everything that you have done for me, I really aprishiate it. I'll never forget you. love. Tonny ... চমৎকার মন ভালো করা লেখা। সমস্ত রাত্রি নির্ঘুম বসে স্যালাইনের টুপটুপ ফোটাগুলোর গড়িয়ে যাওয়া দেখলাম। মনিটরের সবুজ, গোলাপি আর সাদা বক্ররেখার উঠানামার দিকে চেয়ে থাকলাম।চেয়ে থাকলাম রিহানের বুকের পাঁজরের অস্বাভাবিক ওঠানামার দিকে।

এদেশে পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া অবধি হাসপাতালগুলো রোগীকে এক রকম আটকে রাখে, বলা চলে।

আমরাও আটকে থাকলাম। দু'দিন পর বাইরের পৃথিবীতে, পৃথিবীর আলো-বাতাসে এসে দাঁড়াই। বুকভরে শ্বাস নেই। জীবন সুন্দর। তারচেয়েও সুন্দর এই দেশ। এখানে ফার্মেসী থেকে ওষুধ না এনে দেয়া অবধি চিকিৎসা বন্ধ থাকে না, কিংবা টাকার জন্যেও চিকিৎসা বন্ধ থাকে না। আগে সর্বোচ্চ ভালো চিকিৎসাটুকু হবে। বিল পরিশোধের সামর্থ্য যার আছে, সে দিবে। যার নেই, সে দেবার প্রয়োজন নেই। এখানে মধ্যরাতে একজন নারী একাকী হাসপাতালের দিকে ছুটে যেতে পারে নির্ভয়ে, নির্বিঘ্নে। এখানে রাত গভীরে হাসপাতালগুলোয় নার্সরা টেবিলে মাথা নুইয়ে ঘুমিয়ে থাকে না। দিনে রাতে ডাক্তার, নার্স সকলেই সমানভাবে দায়িত্ব পালন করে নিষ্ঠার সাথে। এতোসব সুন্দর আর ভালোথাকার মাঝেও বুকের গহিন কোন থেকে অজান্তেই একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে__ আমার দেশের মানুষগুলো যদি এমন সুযোগ সুবিধাগুলো পেতো !

সেটি আমার জন্ম এবং বেড়ে উঠা দেশ বলেই কি ?

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 Shares

২৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ