জলতরঙ্গ (৭ ও শেষ পর্ব)

ইঞ্জা ১৩ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ০৮:০৫:৩২অপরাহ্ন গল্প ১০ মন্তব্য

এক সপ্তাহ পর
--------------------

ল্যান্ডফোনের রিং বাজতেই আবীর চায়ের কাপ রেখে হ্যান্ডসেট তুলে সালাম দিলো।
আবীর কেমন আছো তুমি, অপর প্রান্ত থেকে এমডি সাহেবের গলা ভেসে এলো।
জি স্যার, ভালো আছি।
গত সপ্তাহে তোমার পাঠানো রিপোর্ট আর রিকুইজিশন নিয়ে আমরা বসেছিলাম, তোমার ধারণাই ঠিক, আমাদের বাগানের চা পাতায় কোনো খারাপ কিছুই পাওয়া যায়নি, তোমার কথা অনুসারে আমি ডিআইজি সাহেবকে বলে একটা ফাঁদ পাতানোর ব্যবস্থা করেছি, আজ তো দশ ট্রাক মাল পাঠাচ্ছো, আশা করছি আজ এর একটা বিহিত হবে।
জি স্যার।
আর তোমার চাহিদা মোতাবেক আমি বাগানের একাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি, তুমি উঠিয়ে ২টা টিউবওয়েল বসানোর ব্যবস্থা করে দাও, ওরা অনেক কষ্ট করছে, আমি বুঝতে পারছি।
ধন্যবাদ স্যার।
বেতনের ব্যাপারটা বোর্ড মিটিংয়ে আমি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি, আশা করি শিগ্রই এর সমাধান হয়ে যাবে।
অনেক ধন্যবাদ স্যার।
নীলা অনেক সুনাম করলো তোমার ব্যাপারে।
আবীর লজ্জিত হলো বললো, স্যার আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি মাত্র।
আবীর কতো ম্যানেজার এলো গেলো, আমি মানুষ চিনতে ভুল করি নাই এইবার, তা নীলা তো কাল রওনা হবে নাকি?
জি স্যার, উনি তো তাই বললেন।
ওকে আমি ওর সাথে কথা বলে নেবো, এখন রাখি।
সালামালেকুম স্যার।

ফোন রেখে আবীর পিয়নকে ডেকে রফিক সাহেবকে সালাম দিতে বললো।
রফিক সাহেব এলে আবীর বললো, আনকেল বসুন।
কি খবর বাবা?
আনকেল আপনি একটু খবর নিন, এইখানে ভালো টিউবওয়েলের কাজ কারা করে, দুইটা টিউবওয়েল দেবো আমরা, কতো ফিট নিচে পানি পাওয়া যাবে, বা প্রতি ফিট কতো করে নেবে, জেনে আমাকে জানান, আমরা দ্রুত টিউবওয়েল দেবো দুই গ্রামে।
খুব ভালো কথা বাবা, আমার পরিচিত একজন আছে, আমি এখনই ডেকে পাঠাচ্ছি।
ঠিক আছে আনকেল, আর হাঁ আমাদের আজ কি ডেলিভারি আছে?
হাঁ, অলরেডি লোডিং হচ্ছে।
তাহলে খবর নেন তো ওদের সাথে আমাদের কেউ যাচ্ছে কিনা, কারা যাচ্ছে আমাকে জানাবেন।
ঠিক আছে বাবা।
রফিক সাহেব বেড়িয়ে গেলে আবীর নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল, একটু পর সেলফোন বেজে উঠলে আবীর স্ক্রিনে দেখলো নীলা কল দিচ্ছে, আবীর রিসিভ করে হ্যালো বললে, অপর প্রান্ত থেকে বললো, আবীর সাহেব কি বেশি ব্যস্ত?
অসুবিধা নেই বলুন, আবীর জবাবে বললো।
আজ আমি রান্না করছি।
বাহ, তাই?
কেনো আমার রান্না কি ভালো হবেনা মনে করছেন?
না না তা ভালো হবে, আমি সিউর।
তাহলে আপনি একটু কষ্ট করে রফিক চাচাকে বলবেন, আজ উনাদের সবার দাওয়াত, রাতে যেন উনারা চলে আসেন।
ওকে বলে দেবো।
থ্যাংকস, আমি রাখি, বিকালে দেখা হবে, বাই।
বাই।

আবীর অফিস থেকে বেড়িয়ে চা পাতা লোডিং হচ্ছে তা দেখতে গেল, সেইখানেই রফিক সাহেবকে দেখতে পেয়ে কাছে গেল।
এই নাও বাবা, একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন, যাতে দুই জনের নাম লেখা।
এরা কারা, আমাদের এইখানেই কাজ করে কি?
না এরা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির লোক, প্রতিবার এরাই যায়।
ওকে চাচা, আমি গ্রামে যাচ্ছি আর হাঁ, নীলা ফোন দিয়েছিলো, আজ আপনাদের দাওয়াত করলো আমাদের বাংলোই, রাতে সবাইকে নিয়ে চলে আসবেন।
কি ব্যাপার, কোনো উপলক্ষ আছে নাকি?
তা আছে, ম্যাডাম আজ নিজ হাতে রান্না করছেন, তাহলে আনকেল রাতে দেখা হচ্ছে?
ঠিক আছে বাবা, দেখা হবে।
আবীর গাড়ী নিয়ে বেড়িয়ে গেল গ্রামের উদ্দেশ্যে, বাগানের আঁকা বাঁকা পথ ধরে এগুচ্ছে, হটাৎ ওর চোখ গেল দূরে বাগানের বড় গাছে অনেক গুলো পাখি জটলা করে বসে আছে, আবীর গাড়ী দাড় করিয়ে বাইনোকুলার নিয়ে পাখি দেখতে লাগলো, আর আফসোস করতে লাগলো, কেন সে আজ ক্যামেরাটা আনলোনা।
বিকেলে বাংলোই যখন ফিরলো, তখন খুবই টায়ার্ড ফিল করতে লাগলো, নীলা কিচেন থেকে বেড়িয়ে এসে বললো, কি ব্যাপার, খুব টায়ার্ড মনে হচ্ছে?
হাঁ, আজ গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখলাম।
ওকে আপনি ফ্রেস হয়ে রেস্ট করুন, পরে আমি ডেকে দেবো, এক সাথে চা খাবো।
ওকে, বলে আবীর নিজ রুমে চলে গেল।

আবীরে ঘুম ভেঙ্গে গেল নীলার ডাক শুনে, আবীর উঠে পড়ুন, সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
আবীর চোখ খুলে বড় একটা শ্বাস নিলো, পুরা ঘরটায় মিষ্টি সুভাষ ছড়িয়ে দিয়েছে নীলা, আবীর আগেও এই সুভাষ পেয়েছে, জানে নীলা এই পারফিউম ইউজ করে।
আবীর উঠে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে এসে বারান্দায় বসলো, না না জাতের ফুল গুলো আজ তাদের গন্ধ বিলাচ্ছে, খুব ভালো লাগে আবীরের।
নীলা আর হারাধন চা নাস্তা নিয়ে এলো, নীলা টিপট থেকে চা ঢেলে আবীরের কাপে, আর নিজেও নিলো।
আবীর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাপ নামিয়ে রেখে বললো, নীলা আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
হাঁ করুন না, নীলা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললো।
জানি আপনি একটা সময় জীবনের সব চাইতে বড় আঘাতটা পেয়েছেন, যা এখনো আপনাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, এ থেকে আপনি নিষ্কৃতি চান না আপনি?
নীলা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললো, চাই তো অবশ্যই, কিন্তু কিভাবে?
আপনি আবার বিয়ে করুন, বলেই আবীর নীলার চোখে চোখ রাখলো।
নীলা কেঁপে উঠলো, কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললো, পুরুষ মানুষকে আর বিশ্বাস করতে পারিনা।
সব পুরুষ তো এক না, সবাই খারাপ কে বলেছে আপনাকে?
তা বলেনি কেউ, কিন্তু একজন ডিভোর্সিকে কে বা বিয়ে করতে চাই বলুন?
আমি যদি চাই, কাঁপা গলায় আবীর বলে ফেলল।
নীলা চমকে উঠলো।
এখনি জবাব দিতে হবে এমন কিছু নেই, আপনি ভেবে দেখুন, ভালো মনে করলে জবাব দেবেন, আমি অপেক্ষায় থাকবো, আসি একটু বাইরে হাটাহাটি করবো, বলেই আবীর উঠে বাইরে চলে গেলো।

নীলা অবাক হয়ে আবীরের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল, ওর কানকেও বিশ্বাস হতে চাইছেনা, নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো সে কি চাই, সে ভাবতেই পারছেনা আবীর ওকে প্রপোজ করেছে, উঠে রুমে চলে গেল নীলা।
যখন রুম থেকে বেরুলো, তখন বাইরে গাড়ীর আলো দেখা যাচ্ছে, রফিক সাহেবরা এসে পড়েছে, আবীরকেও দেখলো আসতে, রফিক সাহেবের গাড়ী থামতেই আবীর এগিয়ে গেল সবাইকে রিসিভ করার জন্য, নীলা মুগ্ধ হয়ে আবীরকে দেখতে লাগলো, আগে আবীরকে এইভাবে দেখেনি নীলা, অনেক স্মার্ট আর কেয়ারিং ও।
রফিক সাহেবদের রিসিভ করে আবীর বারান্দার সোফায় এনে বসালো।
কি মামনি তুমি ভালো তো, মিসেস রফিক এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো নীলাকে।
হাঁ চাচি আমি ভালো, রীতা তুমি ভালো তো, নীলা জিজ্ঞেস করলো।
হারাধন সবার জন্য হাল্কা চা নাস্তা নিয়ে এলে সবাইকে সার্ভ করতে লাগলো নীলা।
আবীর একটু আসবেন, কথা ছিলো, নীলা বললো, চাচা আপনারা শুরু করুন, আমরা আসছি।
আবীর নীলাকে ফলো করে সামনে উঠোনে গেল আরর বললো, জি বলুন।
আপনি কি সিরিয়াস?
সিরিয়াস না হলে বলতামনা।
আপনার ফ্যামিলি নিশ্চয় মানবেনা?
উনাদের সম্মতি নিয়েছি আমি, আমার উপর উনাদের ভরসা আছে।
এ বিয়ে আমি করবোনা।
আবীর দমে গিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
যদি আপনি সিগারেট খাওয়া না ছাড়েন, নীলা সিরিয়াস হয়ে বললো।
আবীর অবাক হয়ে তাকালো নীলার দিকে, এরপর পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে সিগারেট আর লাইটার বের করে ছুড়ে ফেলে দিলো।
নীলার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, বললো, আপনার ফ্যামিলিকে বলুন কাল চলে আসতে, আমার আব্বু আম্মুও কাল আসতেছে।
ওয়াট, অবাক হলো আবীর।
জি জনাব আবীর, আমরা পরশুদিন বিয়ে করবো, বলেই নীলা ভিতরে চলে গেল।

সবার খাওয়াদাওয়া শেষে নীলা সবাইকে ডেজার্ট পরিবেশন করলো, এরপর আবীরের পাশে দাঁড়িয়ে আসতে করে বললো, চাচাদের জানাবেনা?
আবীর হেসে বললো, এতো তাড়াতাড়ি তুমি?
আমি আপনি আপনি করতে পারবোনা, লজ্জিত হেসে নীলা বললো।
ওকে ওকে আমি জানাই তাহলে, আপনাদের একটি সুখবর দিতে চাই আমরা।
এ্যাঃ কি সুখবর বাবা, রফিক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
আমি আর নীলা বিয়ে করবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
বাহ বাহ, বলেই রফিক সাহেব, উনার ওয়াইফ, রীতা উঠে দাঁড়ালো, রফিক সাহেব আবীরকে, মিসেস রফিক নীলাকে জড়িয়ে ধরলো।
খুব খুশি হয়েছি আমরা, অনেক দোয়া তোমাদের জন্য।
রীতাও গিয়ে নীলাকে জড়িয়ে ধরে উইস করে বললো, আমাদের নায়ক তাহলে তুমিই পেলে?
নীলা হেসে আবার রীতাকে জড়িয়ে ধরলো।
চাচা, কাল আব্বুরা আর আবীরের ফ্যামিলি আসতেছে, যা কিছু করার আপনাকেই করতে হবে।
সে কি আর বলতে হবে মা, সব দায়িত্ব আমাদের, চলো তোমাদের আগে মিষ্টি মুখ করাই, আসো আসো।
সবাই বারান্দায় গিয়ে বসলো।

সমাপ্ত।

ছবিঃ Google.

0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ