ক্রীতদাস নির্মম এক ইতিহাস-২

রিতু জাহান ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, সোমবার, ১১:০৩:৩৩পূর্বাহ্ন অন্যান্য ১৯ মন্তব্য

আমরা জানি, গ্রিসের ক্রীতদাস প্রথা অনেক পূরনো। ব্রোঞ্জ যুগের সময় খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০-১১০০অব্দে ক্রীতদাস ছিল। দক্ষিণ গ্রিসের প্রত্নতাত্ত্বিক শহর মাইসনা খননকালে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীন রোমান শহর পম্পেতে পাওয়া যায় এক মৃতদেহ, কালের আবর্তনে তা মূর্তিতে পরিণত হয়েছে। এই মৃতদেহের পায়ে ছিল বেড়ি। ধারনা করা হয় এই মূর্তিটির বয়স ২০০০ বৎসরের পুরনো। খ্রিস্টপূর্ব ৮ম ও ৭ম শতকে স্পার্টা ও মেসিনিয়ার মধ্যকার দুই যুদ্ধে স্পাটার্নরা মেসিনিয়ার সকল আদিবাসীকেই বন্দী করে বিশেষ ধরনের ক্রীতদাসে পরিণত করে। এসব আদিবাসী ক্রীতদাসরা হেলট নামে পরিচিত। প্রাচীন গ্রিক শহরে ক্রীতদাসদের সংখ্যামোট জনসংখ্যার ৩০% এর মত ছিল।
প্রাচীন রোমান সম্রাজ্যঃ গ্রিক ও ফোনেসিয়ান সভ্যতা (বর্তমান লেবানন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এক সভ্যতা যা খ্রিস্টপূর্ব ১২৪০-৫৩৯ অব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল) থেকে উত্তরাধিকার হিসেবেই ক্রীতদাস প্রথাকে পেয়েছে রোমানরা। রোমান রিপাবলিক বাইরেরর দিকে যতো বিস্তৃত হতে থাকে তত সেখানকার সকল আধিবাসীদের তারা ক্রীতদাস বানিয়ে তাদেরকে দিয়ে জোর করে রোমের কৃষিকাজ ও গৃহস্থালি কাজ করাতো। এলিট রোমানরা এভাবে প্রচুর ক্রীতদাস আনতে থাকায় একসময় ক্রীতদাসরাই সংখ্যালগিষ্ঠ জাতি হয়ে ওঠে এবং এক সময় শুরু হয় ক্রীতদাস বিদ্রোহ। স্পার্টাদের নেতৃত্বে তৃতীয় সারভিল যুদ্ধ ছিল তেমন এক ভয়াবহ বিদ্রোহ যুদ্ধ।
নানাপ্রকার এসব যুদ্ধে হেরে যাওয়া বন্দী আদিবাসী ক্রীতদাসদেরকে শুধু শ্রম দেওয়ার জন্যই ক্রীতদাস হতে হয়নি, তাদেরকে মালিক পক্ষকে আনন্দ ও দিতে হতো। যেমন তাদেরকে হতে হতো গ্লাডিয়েস কিংবা যৌনদাসী।
গ্লাডিয়েটর হলো এক ধরনের নির্মম পরিহাসের স্বীকার রোমান যোদ্ধা। তারা তরবারি নিয়ে আরেকজন গ্লাডিয়েটরের সাথে লড়াই করত যতক্ষন এক পক্ষ মারা না যায়। আবার কখনো হিংস্র পশুর সাথেও করতে হতো লড়াই। এসব ভয়াবহ মৃত্যু দেখে রোমানের এলিট শ্রেনীর লোকেরা চিত্তবিনোদনের সুখ খুঁজতো। প্রাচীন রোমান সম্রাজ্যের অন্তত ২৫ ভাগ জনসংখ্যাই ছিল ক্রীতদাস। রোমান সম্রাজ্যের সবচেয়ে উন্নত শহর রোমে বসবাস করত অন্তত ৪০০,০০ ক্রীতদাস। তখন যদি কোনো ক্রীতদাস পালিয়ে যেতো তবে ধরা পড়ার পর তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হতো। ক্রীতদাস প্রথা রোমের অর্থনীতিও উন্নতির অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে ছিল।
রোম রাজতন্ত্র শুরু হওয়ার দুই শতক পূর্বে রোমানরা খুব বেশী সংখ্যায় ক্রীতদাস নিয়োগ করা শুরু করে এবং সে সময় ক্রীতদাসদের সাথে বর্বরতা বাড়তে থাকে। খনিতে ওভারসিয়াগণ ক্রীতদাসদের আরো বেশি কাজ করানোর জন্য চাবুক দিয়ে প্রহার করত, এক কথায় বলতে গেলে এ হতভাগ্য ক্রীতদাসগণ সারাক্ষনই চাবুকের উপর থাকতো। কৃষিতে কর্মরত ক্রীতদাসদের অবস্থাও অনেকটা এমন ছিল। ক্রীতদাসদের সব থেকে ভয়াবহ ছিল গ্লাডিয়েটর হিসেবে কাজ করা। রোমান সম্রাজ্য যতোই বিস্তৃতি লাভ করছিল বিজিত দেশগুলোর প্রায় সকল অধিবাসীকেই ক্রীতদাস হিসেবে ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বিক্রয় করা হতো।
পশ্চিমে রোমান সম্রাজ্যের পতন হলেও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ক্রীতদাস প্রথা চালু থাকে। সাহারার লবন খনিতে ক্রীতদাসের বিশাল বহর কাজ করত।
ক্রীতদাস প্রথা আরো বিকোশিত হতে থাকে এবং এর বড় একটি কেন্দ্র হয়ে ওঠে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল। কারন, অন্য যে কোনো স্থানের চেয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ভৌগলিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক কারনে ক্রীতদাস ব্যবসাকে চাঙ্গা করে তোলে আর এর কেন্দ্রবিন্দু অঞ্চলগুলোর লোক ছিল শিক্ষিত ও সভ্য সমাজের! অন্যদিকে এর উত্তর ও দক্ষিণে তীরবর্তী অঞ্চলে ছিল অপেক্ষাকৃত কম সভ্য ও বিভিন্ন আদিবাসীদের বসবাস। সীমান্ত অঞ্চলে যুদ্ধবিগ্রহের কারনে বিজয়ীরা লুটপাট করে যুদ্ধবন্দিদের জোরপূর্বক ধরে নিয়ে ক্রীতদাস বানাতো।
প্রাচীন রোমান আইনে ক্রীতদাস ছিল পণ্য। অন্য যেকোনো বস্তুর মতো ক্রীতদাস সহজেই ক্রয় বিক্রয় করা যেতো। রোমান ক্রীতদাসদের জন্য তার মালিকের ইচ্ছেই ছিল সবকিছু। যার বিরুদ্ধে তাদের কোনো কিছুই করার অধিকার ছিল না। রোমে প্রথমদিকে ক্রীতদাসদের বড় একটি অংশই আসে। গ্রীক থেকে। প্রচুর সংখ্যক গ্রিককে ক্রীতদাস হিসেবে আনা হয়। ক্রীতদাস ব্যবসায়ীরা তারা তাদের ক্রীতদাসদের বিশেষ যোগ্যতা ও গুণাবলি লিখে তাদের গলায় ঝুলিয়ে রাখতো। আর নারী ক্রীতদাস ও পুরুষ ক্রীতদাস কোনো ভেদাভেদ ছিল না তাদের পোশাকের ক্ষেত্রে। নারীদেরও সম্পূর্ণ বিনা কাপড়ে উঁচু একটি স্টেজে নানা ভঙিমায় দাঁড় করিয়ে রাখতো। অনেক ক্রেতা এসব নারী ক্রীতদাসদের শরীরে বিভিন্ন অংশে স্পর্শ করে দেখতো। অধীকাংশ নারীরা সম্রাটের হেরেমের উদ্দেশ্যে  ও রাজ কর্মচারিদের জন্য ক্রয় করা হতো। হেরেমে গেলে তাদের নামও পাল্টে ফেলা হতো।

ক্রীতদাস, নির্মম এক ইতিহাস-পর্ব ১

0 Shares

১৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ