ওয়েবক্যামে ফুটে ওঠা তরুণীর প্রতিচ্ছবিটি ভরে উঠল নম্রতার মনোমুগ্ধকর আলোয়!
অপার্থিব সেই আলো ভেদ করে সে জানতে চাইল শান্তস্বরে, তোমার নাম?
আমি আমার নাম বললাম।
তরুণী দ্বিধান্বিত কিছুটা। তুমি কি মুসলিম?
না।
দুঃখিত, আমি তাহলে কথা বলব না তোমার সাথে।
আমার মন খারাপ হলো। ধর্মীয় বিধিনিষেধের অব্যাখ্যাত আচারে মানবিক সম্পর্ক সৃষ্টি হবার সম্ভাবনাগুলো কত সহজেই মরে যায়, ঝরে যায় বসন্তের বৃন্তচ্যুত শুকনো পাতা হয়ে!
কী আর করা! বিদায় নূর। ভালো থাকো বহমান নদীর মতো।
নদীর কথায় কেঁপে উঠল মেয়েটির চোখের পাতা। ব্যাধিগ্রস্ত বৃক্ষের অসাড়তায় ডুবে যেতে যেতে সে বলল, তুমি নদী দেখেছো?
কেন দেখবো না? নদীর দেশের মানুষ আমি। নিরুত্তপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলাম।
আমি কখনও নদী দেখিনি।
কোথায় থাকো তুমি?
মালয়েশিয়া।
তুমি যেখানে থাকো কাছাকাছি কোন নদী নেই?
না। কয়েকটি অগভীর জলাশয় আছে। যমুনার মতো গভীর নদী নেই।
মেয়েটির কথায় চমকে উঠলাম আমি, বললাম, তুমি যমুনা নদীর কথা জানলে কীভাবে? যমুনা তো আমার দেশের নদী!
তোমার দেশের নদী? বিস্ময়ে অভিভূত মেয়েটির বিস্ফারিত চোখের মণিতে যমুনার সবুজাভ ঢেউয়ের ওঠাপড়া ভেসে উঠল। বাকরুদ্ধ কণ্ঠে সে বলল, তুমি বাংলাদেশে থাকো?
আমি হতচকিত স্বরে বললাম, হ্যাঁ! তুমি চেনো আমার দেশকে?
চিনি তো! ভীষণ ভালোভাবে চিনি! তারপর একটু থেমে মেয়েটি আমাকে প্রশ্ন করলো আবার, আচ্ছা, তুমি কী হাসানকে চেনো?
হাসান? বিহ্বলতা আমার কণ্ঠে।
হাসান! মানে হাসান ইকবাল!
হাসান নামের মানুষটিকে চেনাবার প্রাণপণ চেষ্টা মেয়েটির!
অনন্যোপায় আমি না চেনার ব্যর্থতা কাঁধে নিয়ে বললাম, না, আমি ঠিক চিনি না তাকে!
হাসান আমাকে বাংলাদেশের গল্প বলেছে। ওর বাড়ি যেতে পাড়ি দিতে হয় যমুনা নদী। নদীতে অনেক শাপলা ফোটে, তাই না?
আমি ভিনদেশী মেয়েটির কথায় আবেগাপ্লুত হলাম! বললাম, স্রোতস্বিনী নদীতে সাধারণত শাপলা ফোটে না। যে নদীর স্রোত রুদ্ধ, যে নদী যৌবনহারা, বৃদ্ধ অথবা মৃতপ্রায়, সে নদীর অগভীর জলে শাপলা বাসা বানায়। এক নিঃশ্বাসে বললাম আমি।
তুমি কী কবি? নূরের কণ্ঠে আবিষ্টতা!
না। আমি শ্রমিক, আমি আমার শ্রম বিক্রি করি শহরে। আমার স্পষ্টস্বর।
হাসান কবি। ভীষণ সুন্দর কবিতা লেখে ও।
হাসানকে আমার শুভেচ্ছা দিও।
কীভাবে তোমার শুভেচ্ছা ওকে দেবো আমি! ওর কোনো ফোন নাম্বার নেই আমার কাছে! নূরের বিষন্ন জবাব।
বিষয়টি চিন্তায় ফেললো আমাকে। আমার কৌতূহল ওদের মধ্যকার সম্পর্কের গ্রন্থি উন্মোচনে প্রবৃত্ত হলো। সংকোচের অস্বচ্ছ দেয়াল ভেঙে জানতে চাইলাম, তোমার সাথে হাসানের যোগাযোগ কীভাবে?
হাসান আমাদের দেশে এসেছিল কাজ করতে। আমাদের বাসার কাছেই ওদের কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। আমাদের পরিচয় এলাকার শপিং মলে। ধীরে ধীরে ওর সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হবার পর আমি ওকে বাড়ি নিয়ে যাই। পরিচয় করিয়ে দেই মায়ের সাথে। আমার বাবা মারা যাবার পর মা-ই আমাদের পরিবারের সবকিছু। মনের অর্গল ভেঙে অনেক কথাই বলে ফেলল মেয়েটি, একনিঃশ্বাসে।
তারপর? অকৃত্রিম আগ্রহ আমার কণ্ঠে।
এই যে এনগেজমেন্ট রিং, এটা হাসানের দেয়া। নূরের বাম হাতের অনামিকার শোভা বাড়াচ্ছে একটি সুন্দর আংটি।
তারপর?
প্রায় এক বছর হলো দেশে ফিরেছে হাসান। বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসার পর আমাদের বিয়ে হবার কথা। বিয়ের পর আমাদের যাবার কথা যমুনার পাড়ে।
তাহলে অপেক্ষা করো। জেনো, অপেক্ষার ফল সবসময় মধুর হয়। অনিঃশেষ শুভকামনা ভরা গলায় উচ্চারণ করলাম আমি।
কিন্তু ওদের কোম্পনির সুপারভাইজার কয়েকদিন আগে বললো হাসান আর ফিরবে না কাজে! ও নাকি দেশে ফিরে বিয়ে করেছে! মেয়েটির বিচলিত কণ্ঠস্বর।
আমি চুপ করে রইলাম। অনভিপ্রেত এক আশংকার মেঘ জন্ম দিলো ধূসর সময়ের।
মেয়েটি মনের অতলে সকরুণ রক্তপাতকে ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বাস দিয়ে ঢেকে দেবার চেষ্টা করতে করতে বলল, আমি কিন্তু সুপারভাইজারের কথায় কান দেইনি একদম! ও ভীষণ মন্দ লোক!
আমি সংশয়ভরা কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম, মানুষকে চেনা খুব কঠিন নূর!
মেয়েটি ত্রস্তস্বরে বলল, না না, আমি ভালোভাবে চিনি ওকে। আমার আর হাসানের ভালোবাসা ও কখনওই ভালো চোখে দেখেনি!
তোমার উপলব্ধি যথার্থ হোক নূর! আদ্রকণ্ঠে বললাম আমি।
আমার কণ্ঠস্বর দ্রবীভূত করল মেয়েটির মনকে। সে সলাজ ভঙ্গীতে বলল, আমাকে একটু সাহায্য করবে? হাসানকে একটু খুঁজে দেবে তুমি? ফিরিয়ে আনবে আমার কাছে?
না, বর্ণময় কোন আশ্বস্ততার কথা উঠে এলোনা আমার কণ্ঠনালীতে!
আমি বলতে পারলাম না কিছুতেই, যদি কোন মানুষ হারিয়ে যাবার জন্য জীবনে আসে, একজীবনে তাকে ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব!
ছবি: সংগৃহীত
১৮টি মন্তব্য
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
কেন জানি তিনবার পড়লাম ! ^:^
দীপংকর চন্দ
কৃতজ্ঞতা ভাই।
আমার শুভকামনা জানবেন। অনিঃশেষ।
ভালো থাকবেন। সবসময়।
অরুনি মায়া
নূর এর হৃদয় ভাঙা শব্দ হাসানের কানে পৌঁছাল না |
দীপংকর চন্দ
সানা নূর আর তার পরিবারের জন্য শুভকামনা।
শুভকামনা আপনার জন্যও। অনিঃশেষ।
ভালো থাকবেন। অনেক ভালো। সবসময়।
অপার্থিব
নি;সন্দেহে দারূন একটি লেখা। বিদেশে আমাদের দেশের শ্রমিকদের মানবেতর জীবন , তাদের অন্যায় অবিচারের স্বীকার হওয়া নিয়ে অনেক \কথাই হয় কিন্ত আমাদের শ্রমিকেরা যে বিদেশে নানা অন্যায় ও অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে এটা খুব একটা মিডিয়ার ফোকাসে আসে না। বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর আগে আরো ভাল মত যাচাই বাছাই করা উচিত।
দীপংকর চন্দ
মন্তব্যে শ্রদ্ধা।
দেশে হোক কিংবা বিদেশে, নৈতিকতা সম্ভবত খুব বড়ো একটা ব্যাপার!
অনিঃশেষ শুভকামনা থাকছে।
অনেক ভালো থাকবেন। সবসময়।
নীলাঞ্জনা নীলা
প্রথম গল্প পড়েই বুঝে গেছি আমাদের সোনেলায় এমন একজন গল্পকারের আগমন হলো, যাঁর লেখনী আমাদের চারপাশকে ঘিরে।
যার চরিত্র যেনো আমরাই।
আমাদের গল্পকার আরোও লিখুন এমন।
দীপংকর চন্দ
আরে না না!! কি যে বলেন!!
এটি কোন গল্প নয়!
এখানে আমার লেখার ভূমিকা একেবারেই সামান্য। অথবা অনুল্লেখযোগ্যও বলতে পারেন।
শুভকামনা অনিঃশেষ।
ভালো থাকবেন। অনেক। সবসময়।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপনার লেখার হাত খুবই ভালো, তেমনি ভাবনাও।
দীপংকর চন্দ
প্রার্থণা করবেন নীলাঞ্জনা নীলা,আমার মাথা যেন নত থাকে কৃতজ্ঞতায়, সবসময়।
শুন্য শুন্যালয়
ভোরে পড়েছি লেখাটি। এ লেখায় মন্তব্য করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে 🙁
আপনি অনেক অনেক ভালো লেখেন দীপংকর।
দীপংকর চন্দ
বড়ো মনের মানুষের আন্তরিকতাও বড়ো হয়।
তবে আমার লেখার চেষ্টা এখানে গৌণ ভীষণ।
এটি কোন গল্প নয়।
আমার শুভকামনা অনিঃশেষ জানবেন।
ভালো থাকবেন। সবসময়। অনেক।
নীতেশ বড়ুয়া
চমৎকার।
আর কিছু বলার মতো নেই, শুধু বারেবারে পড়ে যাওয়া।
দীপংকর চন্দ
কৃতজ্ঞতা নীতেশ দা উপস্থিতিতে।
অল্প সময়ে আপনার আন্তরিকতার প্রতি শ্রদ্ধা জন্মেছে আমার। বিশেষ করে লীলাবতীর জন্মদিন এবং শিশির কণার নতুন জীবন সংক্রান্ত আয়োজন দুটো। মন ছোঁঁয়া।
অনিঃশেষ শুভকামনা।
ভালো থাকবেন। সবসময়।
নীতেশ বড়ুয়া
দাদা, কথায় আছে ‘পাওয়ার আগে দিয়ে যাও’ এখানে উল্টো। আন্তরিকতা আমি পেয়ে এসছি শুরু হতেই তাই তার প্রতিফলন হয়তো কিছুটা এসেছে। যদিও যেমন করে ভাবি তেমন করে কয়া হয়ে উঠেনি ঐ দুটোতেই। বরাবরই মনে হয়েছে অনেক কম হয়েছে বলা :p (আমি আবার বকবক বেশী করি)
তবে আপনাদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ।
আপনাকে আরো চেনার জন্য আপনার নতুন নতুন প্রকাশনার অপেক্ষায় রইলাম।
শুভ কামনা দাদা -{@
দীপংকর চন্দ
//(আমি আবার বকবক বেশী করি)//
তাই নাকি!!!
এমন গুরুত্বপূর্ণ বকবক করতে পারা তো ইর্ষণীয় হতে পারে অনেক মানুষের জন্য!!
হা হা হা হা
শুভকামনা নীতেশ দা। পুনরায়।
লীলাবতী
আপনি বললেই হবে, এটি কোন গল্প নয়? 🙂
ভালোলাগা জানিয়ে গেলাল্ম।
দীপংকর চন্দ
হা হা হা হা
তাই তো!! আমি বললেই হবে কেন??
জীবন তো গল্পই!! টুকরো টুকরো অজস্র গল্প ঘিরে থাকে মানুষকে!
ছোট্ট সুন্দর মন্তব্যে ভালো লাগা অনেক।
অনিঃশেষ শুভকামনা।
ভালো থাকবেন। অনেক ভালো। সবসময়।