৪র্থ পর্ব (সত্য ঘটনা অবলম্বনে);
সেখানে (কুতুবদিয়ায়) এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কয়েকটা গ্রামের একূল-ওকূল সব দেখা যাচ্ছিলো। কারণ কোন গাছপালা বা বাড়ি ঘরের সজীব উপস্থিতি সেখানে ছিলো না। বড় বড় গাছ যেগুলো ছিল তাও যেন এসিড দিয়ে গোসল করেছে। দ্বীপ কুতুবদিয়া যেন পুড়া ভিটার মত তামাটে হয়ে গেছে। গাছের অনেক উঁচুতে হয়ত দেখা যাচ্ছে কারো ছিড়া লুঙ্গি অথবা গেঞ্জির টুকরা, কারো ওড়না অথবা ফিতার অংশ। আমি ওদের ঝুপড়ির নিকট যাচ্ছি আর ওরা ছেলেমেয়ে এবং নিজেদেরকে নিয়ে আমার সামনে আসছে চিকিৎসার জন্য। কেউ কেউ পরনে পর্যাপ্ত বস্ত্র নেই বলে আমার সামনে আসতে পারছে না লজ্জ্বায়। কেউ বলে ডাক্তার সাব আমার মেয়ের এই অবস্থা, কেউ বলে স্যার আমি তো মরে গেলাম। আমি তখন ডাক্তার। আমার বেশী পকেটওয়ালা সাফারীর বিভিন্ন পকেটে ভিন্ন ভিন্ন ওষুধ মওজুদ রেখেছিলাম। আমার পাশে পাশে মেডিকেল বক্স নিয়ে সেলিম ভাই ছিলো। মেডিকেল বক্সে খাবার স্যালাইন, প্যারাসিটামল, হিসটাসিন, এভোমিন ট্যাব, ডেটল-সেভলন, পানি শোধক ট্যাব, ডায়রিয়ার ট্যাব ও ক্যাপ, কারমিনা, বার্মার বাম, কটন ইত্যাদি ছিলো।

আমি গরম পানি দিয়ে নিজ হাতে যত্নের সাথে ক্ষতস্থান ধুয়ে কটন দিয়ে পরিস্কার করে সেখানে প্রয়োজনীয় ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছিলাম এবং টেবলেট ইত্যাদি কিভাবে খেতে হবে তা বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম। আমি যেখানে যেখানে যাচ্ছি সেখানেই আমাকে ঘিরে জটলা হয়ে যাচ্ছে। রুগিদের আ: উ: ইত্যাদি আর্তচিৎকারে পরিবেশকে আরো বেশী বেদনাহত করে তুলছে। আমি অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছি এবং সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের অন্য গ্রুপগুলো এলাকার অন্য পাশে যার যার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।

এলাকার গন্যমান্য সুস্থ লোকেরা ওদেরকে সহযোগিতা করে যাচ্ছিলো। আমার সাথে সেলিম ভাই ছিল। আমার ওষুধের দরকার হলেই সেলিম ভাইকে কল করছিলাম। আর সেলিম ভাইও জ্বী স্যার, কম্পাউন্ডার হাজির, আপনার কি চাই? বলে বিনয়ের সাথে আমার সামনে মেডিকেল বক্স এগিয়ে দিচ্ছিলো। সেলিম ভাইয়ের বলার ভঙ্গি দেখে আমি দু:খের মাঝেও না হেসে পারছিলাম না।

সবাই আমাকে ডাক্তার সাব, স্যার বলছে দেখে সেও নিজেকে কম্পাউন্ডার বানিয়ে নিয়েছে। সেলিম ভাইও আমার সমবয়সী সৎ, সুন্দর এবং কর্মট এক সাহসী যুবক। আর্তমানবতার সেবায় সাগর পাড়ি দিয়ে আমাদের সাথে ছুটে গিয়েছিলো দ্বীপ কুতুবদিয়ায়। সেলিম ভাই একজন ব্যবসায়ী, চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে ব্যবসা করেন। বর্তমানে অনেক বড় ব্যবসায়ী।

আমি রুগিদের কারমিনা খাইয়ে দিচ্ছিলাম, ডায়রিয়ার খাবার স্যালাইন দিচ্ছিলাম। খাবার পানির কলসীতে পানি শোধক ট্যাবলেট দিচ্ছিলাম। আহত রুগীদের ক্ষতস্থান গরম পানিতে ধুয়ে কটনে ডেটল/স্যাভলন লাগিয়ে পরিস্কার করে দিচ্ছিলাম। আমি নিজ হাতেই এসব করছিলাম। ছোটকালে আমার মনটা খুবই কোমল নরম ছিল, মানুষের কষ্ট দেখলে নিজে নিজে খুব খারাপ লাগত। মাঝে মাঝে মনে হতো, নার্সিং এর উপর কোর্স করে রুগিদের সেবা করবো, যাক।

ওদের শরীরের কাটা ঘা, বিনা চিকিৎসায় বা অযত্নে দূর্গন্ধ বের হচ্ছিলো অথচ আমার ইচ্ছে হচ্ছে ওদেরকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে তাদের সাথে মিশে যেতে, তাদের কষ্টের ভাগ নিতে। কোন রকম বিরক্তি বা অসহিষ্ণুতা আমি অনুভব করিনি। বরঞ্চ ওদের দু:খ দেখে আমার বুক ফেটে কান্না আসছিল। মাঝে মাঝে নিজেকে সংযত রাখতে পারছিলাম না। চোখের অশ্রু লুকাতে এক পাশে সরে যেতাম প্রকৃতির যুদ্ধ-বিধ্বস্থ দৃশ্যাবলী দেখার ভান করে। এভাবে মানুষের সেবা করে কত আনন্দ যে পাচ্ছিলাম তা ব্যক্ত করার মত ভাষা আমার জানা নেই। মনে মনে আল্লার দরবারে শোকরিয়া করছিলাম এমন বিপদগ্রস্ত মানুষের সেবা করার জন্য আমাকেও মনোনিত করেছেন বলে। মানুষের সেবা করে এত আনন্দ পাওয়া যায় তা আমি কখনোই ভাবতে পারিনি। আমার মনে হলো এই আনন্দ আমি আর কোন দিন পাবনা। তাদের সাথে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছিলো।

সেদিনের দৃশ্য মনে পড়লে এখনও আমি অবিভূত হয়ে যাই। দূর্গতদের প্রকৃত সাহায্যতো স্ব-শরীরে দূর্গত এলাকাতে গিয়েই সম্ভব। অথচ তখন শহরের মাঝে দূর্গতদের সমর্থনে কত জনদরদী কথার খই ফুটাচ্ছিলো আর পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছিলো। সামান্য টাকার চেক অথবা একটি সেলাই হাতমেশিন দিয়ে পর্যন্ত ছবিসহ পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিলো ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর। আমাদের ত্যাগ আর সাহসটা এমন ছিল যে ঠিকমত যোগান বা প্রচার পেলে ইহা জাতিসংঘ পুরস্কার পেতে পারতো। অথবা জাতীয় পর্যায়ে মানব সেবার স্বীকৃতি পেতে পারতো যদিও আমাদের সেরকম উদ্দেশ্য ছিলো না। আর সেদিন যদি আমাদের সাথে একটি ক্যামেরা থাকতো তাহলে আমরা বাজিমাত করে দিতে পারতাম। জলজ্যান্ত সব ছবি তুলে ধরে বিশ্বকে চমকে দিতে পারতাম।

আমি ভাবছিলাম ওদের কথা। ওরা এবং আমরা সবাই একই দেশের অধিবাসী। দেশ আমাদের সবার কাছ থেকে টেক্স বা খাজানা আদায় করে। অথবা দেশের প্রতিনিধি নির্বাচনে আমাদের মত ওদেরও একটি ভোটের অধিকার রয়েছে। অতচ সমুদ্রতীরবর্তী এই দূর্যোগপূর্ণ এলাকাতে ওরা একা থাকছে। আর আমরা থাকছি অপেক্ষাকৃত কম ঝুকিপূর্ণ এলাকায়। অত্র লেখার মাধ্যমে সরকারের কাছে আমার দাবী হচ্ছে বাংলাদেশের সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের নাগরিক সুবিধা শতভাগ নিশ্চিত করা হোক।
সমুদ্র পথে অনেক বৈদেশিক যোগাযোগ, মৎস এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সব আমরা ভোগ করবো আর সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, মহামারী, ইত্যাদি ভোগ করবে ওরা একা এটা কেমন কথা? অতচ এই আসমানী বালাগুলো আমরা শহর বাসীর কারণেই বেশীর ভাগ এসে থাকে। মনে পড়ে ঘূর্ণিঝড়ের কিছুদিন আগে ঢাকা গিয়েছিলাম। সেখানে মানবতার যে পাপী, ঘৃণ্য, নগ্ন চেহারা দেখেছিলাম, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে কান্ডসমূহ দেখেছিলাম এবং সারা দেশে চেয়ার কোচের নামে যে ভ্রাম্যমান সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। চারিদিকের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বুঝাই যাচ্ছিলো যে দেশবাসীকে মহান আল্লাহ একটু সতর্ক করে দিতে পারেন। এটা তখন সময়ের দাবী ছিলো বলতে হবে। দেশের চা দোকান গুলো ছিল এক একটা সিনেমা হল। ভারতীয় অর্ধ-নগ্ন ছবি ভি.সি.আর এর মাধ্যমে ১০/২০ টাকার বিনিময়ে, চা-পরোটার বিনিময়ে এলোপাথাড়ি প্রদর্শন করা হচ্ছিলো।

যাই হোক, আমরা দৃশ্য বদল করে অনেকদুর এগিয়ে গেছি। এখন আবারো আগের দৃশ্যে ফিরে আসা যাক। পূর্বোক্ত বর্ণনায় মেডিকেল বক্সে আমরা যে কটনের উল্লেখ করে এসেছি সেই কটনই সাগরে ঝাঁপ দেওয়ার আগে কানের ছিদ্র পথে আটকে দিয়েছিলাম। আবারো ফিরে আসছি আগের বর্ণনায়। আমি এখন সাগরের ঢেউয়ে ভাসছি আর লোকটি আমার বুকের উপর। জাহাজ থেকে ধীরে ধীরে রশি টানা হচ্ছে। রশির টানে আমি ক্রমান্বয়ে জাহাজের বিশ হাতের মধ্যে চলে আসলাম। জাহাজ থেকে উৎসুক তিন তলার তিন সারি জনতা আমাকে উৎসাহিত করছিলো।

এভাবে লোকটি সহ আমি যখন জাহাজের আরো কাছাকাছি চলে এলাম, তখন সাগরের শক্তিশালী ঢেউ এবং ছন্নছাড়া বাতাসের ঝাপটা আমাকে জাহাজের গা ঘেসে পেছনের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। আমার বুকের উপর একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ। পানি আমাকে বিপদ সীমার মধ্যে নিয়ে গেলেও ঐ অবস্থায় আমার করার কিছুই ছিলো না। আমি তখন সম্পূর্ন অসহায় অবস্থায় ছিলাম।

পানির ঝাঁপটা আমাকে জাহাজের গা সেঁদে সেঁদে পেছনের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। সাগরের ঢেউ এবং বাতাসের ঝাঁপটার এমন অশৌভন আচরণে আমি কেমন যেন বিব্রত বোধ করতে লাগলাম। ঠিক এ ধরনের একটা পরিস্থিতির জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কোন কৌশলই মাথার মধ্যে আসছে না। বিশাল জাহাজের ডক থেকে নিচের দিকে ইংরেজী ভী আকৃতির হওয়ায় আমি উপরের কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। ততক্ষণে পানি আমাকে জাহাজের পেছন বরাবর নিয়ে গেছে।
এমন সময় আমার মনে পড়ল জাহাজের পেছনেই তো রয়েছে সেই ভয়ঙ্কর শক্তিশালী পাঁখা যার সাহায্যে দানবের মত এই বিরাটকায় জাহাজটি চলন ক্ষমতা পায়। যার নাগালের মধ্যে গেলে আমাকে ছাতু বানিয়ে ছাড়বে। এটা মনে হতেই আমি দু’হাতে এলোপাতাড়ি রশি টানতে শুরু করলাম। আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো এই বিপদজনক অবস্থান থেকে তাড়াতাড়ি নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে।

(চলবে)
# সিরিজটি মোট ৭ পর্ব

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ