বুড়িগঙ্গা আজ মৃত। তাই হয়ত ঢাকাও এখন মৃতপ্রায় নগরী। আমি দু'মাস আগে ছেলেদের নিয়ে আহসান মঞ্জিল গিয়েছিলাম। নদীর কোলঘেঁষে যে রাস্তাটা গেছে ঐ রাস্তা দিয়ে রিক্সা করে যেতে যেতে নাকে কাপড় দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। নদীর পাড়ে যতদূর চোখ যায় সে এক বীভৎস দৃশ্য! রাস্তার একপাশে বস্তি আর নদীর পাড়গুলোতে যতো ময়লা আবর্জনার স্তুপ। দেখে মনে হলো বাংলাদেশের যতো ভাংড়ি, ভাঙ্গা পুরানো বোতল, প্লাস্টিক, যতো পুরাতন জুতা স্যান্ডেল, কলকারখানার বর্জ্য, কেমিক্যাল বড় বড় ড্রেনের মাধ্যমে এসে পড়ছে নদীতে। এ যেন এক মহা নোংরার পরিবেশ।
12067135_788339351271145_1416597243_n
অবশেষে এসব দেখতে দেখতে আহসান মঞ্জিল ভবনটিতে পৌঁছলাম। ভবনটি দেখে আমার নয়ন মন দুটোই ভরে গেলো। দেখা শেষ করে এর প্রাঙ্গনে এসে বসলাম। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম এর অতীত চিত্র। আর ভাবছিলাম নবাব লোকটি সৌখিন ছিলো বটে!

আসলে মোঘলরা এই নদীর জোয়ার ভাটার রূপ দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে গিয়েছিল। তাই হয়ত এর কোল ঘেসে তৈরী করেছিল এই ভবন। বুড়িগঙ্গা ঢাকা শহরের দক্ষিণ এবং পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত জোয়ার ভাটা প্রভাবিত একটি নদী। নদীটির নামকরণ নিয়ে সনাতন একটি কাহিনী আছে। "প্রাচীনকালে গঙ্গা নদীর একটি প্রবাহ ধলেশ্বরীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। তাই আমরা এই প্রবাহটি অর্থাৎ বুড়িগঙ্গাকে ধলেশ্বরীর শাখাও বলি। ধীরে ধীরে এই প্রবাহটি ভৌগলিক ও মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অর্থাৎ এক কথায় সহজভাবে যদি বলি মানুষের অবচেতন মনেও প্রকৃতির খেয়ালে নদীটি শাসন হয়ে এর প্রবাহ দিক পরিবর্তন করে। যার ফলে গঙ্গার সাথে এর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর এই বিচ্ছিন্ন প্রবাহটিই আজকের বুড়িগঙ্গা। এই বুড়িগঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহটি ঢাকা শহরে খুবই সুস্থিত। যা এখন শুধুই কল্পনা। ঢাকা শহরের জন্য বুড়িগঙ্গা নদী অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা নতুন কথা নয়।

যাই হোক আমি যে বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছি তা হলো, ঢাকা দূষণমুক্ত, বুড়িগঙ্গা যেন তার প্রাণ ফিরে পায় তাই নিয়ে।

প্রথমে আসি,বাংলাদেশের অন্যতম একটি শিল্প চামড়া শিল্প ও তার প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি ও স্থান নিয়ে, যাকে আমরা বলি ট্যানারি। প্রথমে এই ট্যানারি স্থাপন করেন রণদাপ্রসাদ সাহা ১৯৪০ সালে নারায়ণগঞ্জে। পরে দেশ বিভাগের পরে পাকিস্তান সরকার ঢাকা ও বুড়িগঙ্গার বারোটা বাজাতে এই ট্যানারি ঢাকার হাজারীবাগে স্থানান্তর করে। কাঁচা চামড়ার প্রাথমিক পর্যায়টি তারা ঢাকাতেই সেরে ফেলত, অর্থাৎ চামড়াকে ওয়েট ব্লুতে রুপান্তর করে তা পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিত পরবর্তী প্রসেসের জন্য। যেখানে কোনো ময়লা বা দুর্গন্ধ ছড়ানোর সুযোগ থাকতো না। ময়লা,বর্জ্য দুর্গন্ধ তা এই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেই থাকত। কারণ ক্ষমতার জোরে বেশিরভাগ ট্যানারি অবাঙ্গালীদের হাতেই সীমাবদ্ধ ছিলো। বাঙ্গালীদের মালিকানায় ছিলো যা তা অতি ক্ষুদ্র পরিসরে। ১৯৭১ সালের পর অবঙ্গালীদের ছেড়ে যাওয়া ৩০টি ট্যানারি পরে বাংলাদেশ সরকার এর দায়িত্ব দেন পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ট্যানারি কর্পোরেশন, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য তারা এর সুষ্ঠু ব্যাবস্থাপনা করতে পারেননি।
12674524_788339311271149_915912716_n
বর্তমানে বাংলাদেশে ২০৬টি ট্যানারি ইউনিট রয়েছে। যার কর্মী সংখ্যা ৬০ হাজার। বর্তমানে সরকার এর অবকাঠামোগত সকল সুযোগ সুবিধা  দেবার জন্য সাভারে ৪০০একর জমির উপর গড়ে তোলা হচ্ছে চামড়া শিল্প। কিন্তু তা ঐ উজানমুখী সাভারে। এটি কি আদৌ পরিবেশ বান্ধব হবে? কারণ বাংলাদেশ বৃষ্টি প্রবণ এলাকা। আর পানির ধর্ম হলো উঁচু থেকে নিচে গড়িয়ে নামা। তাছাড়া যখন বৃষ্টি হবে তখন পানির সাথে দূষণকারী আবর্জনাও নিন্ম মুখি হবে। আর গাজিপুর, সাভার, টঙ্গি থেকে ঢাকা শহর নিন্মাঞ্চল। ঐ অঞ্চল গুলি যেহেতু ঢাকার উজানে তাই ঐ এলাকার পরিবেশ দূষণকারী যে কোনো স্থাপনা স্থাপিত হলে সেই সকল স্থাপনার বর্জ্য প্রাকৃতিক ভাবেই নিন্ম মুখি হবে। তখন এসব এলাকা বা শহরে ট্যানারিসহ মানুষের স্বাস্থ্য হানিকর বর্জ্য উৎপাদন কারী স্থাপনা স্থাপন করলে স্বাভাবিক ভাবেই বর্জ্য গুলি বৃষ্টির কারণে নদীনালা ও মাটির উপর দিয়ে পানির ধর্ম আনুযায়ী নিম্নাঞ্চলে অবস্থিত ঢাকা শহরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই বিশাল জনবহুল ঢাকা দূষিত হবে। যার ফলে ঢাকা শহরে বসবাসকারী সর্বস্তরের নাগরিকের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে।
12324928_788339177937829_1285132824_n
এবার আসি যতো ময়লার স্তুপ নিয়ে। আমরা জানি প্লাস্টিক মাটিতে সহজে পঁচে না। যত্রতত্র এর ব্যবহারের ফলে নষ্ট হচ্ছে আজ পরিবেশ। আইন আছে, নেই কোনো প্রয়োগ। ডিজিটাল হলে কি হবে অবুঝ মূর্খতায় ভরা এক দেশ আমার। যার যেখানে ইচ্ছা সিগারেট খাচ্ছে, মল মূত্র ত্যাগ করছে, ময়লা ফেলছে। সব আবর্জনা এই বুড়িগঙ্গার বুকে কেন? বড় বড় কাভার্ড ভ্যানে করে এই আবর্জনা ঢাকার বাইরে নিয়ে ফেলা যায়। এই আবর্জনা দিয়ে কিভাবে নতুন কিছু করা যায় সেই পরিকল্পনা হাতে নেওয়া যায়। নদীর নাব্যতা ফিরে আনতে ড্রেজিং করে এর ময়লা কাঁদা মাটি মোটা মোটা পাইপের মাধ্যমে ঢাকার থেকে দূরে ফেলা যায়। মাটি ভরাট কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে। আমার মনে হয় এই ট্যানারি যতোটা না বুড়িগঙ্গা ও ঢাকার সর্বনাশ করছে তার থেকে কয়েকগুণ নষ্ট করছে এই বস্তির বর্জ্যগুলো। অথচ ঢাকাকে বাড়াতে গাজীপুরে মধুপুর বন ধ্বংস  হচ্ছে। যেখানে যে কোন ব্যাক্তি মালিকানায় দুই কাঠা কিনলে সাথে আরো দুই কাঠা দখল করছে। আর বুড়িগঙ্গার পাশে যে বস্তি গড়ে উঠেছে এই পলিথিন তথা ভাংড়ি গুলোর কারণে তা কেউ দেখছে না। অথচ এখান থেকে বর্জ্যের এই ব্যবসা বন্ধ হলে বস্তিও উঠে যাবে অটোমেটিক্যালি। তাই আইন করে তা বাস্তবায়ন করে এখানে ভাংড়ি বর্জ্য জমা করা বন্ধ করতে হবে।

ঢাকাকে বাঁচাতে হলে ঢাকা মুখি লোক অর্থাৎ নিম্ন শ্রেণীর লোকের ঢাকা যাওয়ার প্রবণতা কমাতে হবে। সবারই ধারনা ঢাকা গেলে অনেক টাকা আয় করতে পারবো। কিন্তু তা কি আদৌ সত্যি? নিজ নিজ গ্রাম বা শহরে কতো কাজ। শুধু দরকার মানসিকতা ও পরিকল্পনা। আমার প্রশ্ন নিজ নিজ গ্রামে বা  শহরে নারীরা কাজ করছে না কেন? নারী তার নিজ নিজ এলাকাতে কাজ করছে না? আমি একটা জরিপ করেছিলাম, পাবনাতে, কুড়িগ্রাম ও আমার এলাকা মোংলাতে। যারা ঢাকা গিয়ে বিভিন্ন কাজ করে তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন এসব নারীরা ঢাকায় কাজ করছে। তাদের ভাষ্যমতে নিজ এলাকায় কাজ করলে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। অনেক বিড়ম্বনা। যেমন অমুকের বউ এই এ কাজ করছে, ওমুকের বোন, মা এই কাজ করছে, তাদের অবস্থা খুব খারাপ। এমনি ভাবনা হয় এলাকার মানুষের। কিন্তু কেউ সাহায্য তেমন এগিয়ে আসে না। অথচ প্রশ্ন করে অনেক। তা যতো ভালো কাজই হোক না কেনো। কিন্তু ঢাকা গেলে তো কেউ দেখবে না, কি কাজ করছে কোথায় কি করছে? ঢাকার মানুষের এতো সব অযথা সময় নেই। তাই অনেকেই স্বামি স্ত্রী ছোট ছোট বাচ্চা গ্রামে রেখে চলে যায় ঢাকা শহরে। তারা হিসাব করে একজনের টাকা দিয়ে সংসারের খরচ চলবে অন্যজনের টাকা জমবে ভবিষ্যতের একটা আশ্রয়ের জন্য। পরিকল্পনা মতো এই লোকগুলো কাজও করে। যখন টাকা জমিয়ে স্ত্রীটি স্বামীর ভিটায় একখানা ঘর তোলে গরু কেনে কেউ সেলাই মেশিন কেনে। কিছুদিন অনেকেই সুন্দর জীবন চলে। কিন্তু হঠাৎ ই স্ত্রীটি শোনে তার স্বামীটি নগর জীবনের নিঃসঙ্গতায় আর একটি বিয়ে করেছে কোনো এক গার্মেন্টস কর্মী অথবা গৃহকর্মীকে। স্ত্রীটি হয় আবারো গৃহহারা। সে পুনরায় চলে যায় মোটামুটি বড় হয়ে যাওয়া কোলের সন্তান নিয়ে ঢাকা। এভাবে বেড়ে চলেছে ঢাকামুখী নিম্নশ্রেণীর লোক।

আমার বাসার বানু, দুই সন্তানের মা। যথেষ্ট পরিশ্রমী। একটা ঘর নেই। লোন তুলে একটা ঘর করেছে। কিন্তু এই লোন শোধ করা হলো এখন ওর দায়। তাই লোন শোধ করতে ওর স্বামী ছুটল ঢাকা রিক্সা চালাতে। বানুর এদিকে কান্না শুরু, সেও যাবে ঢাকা। ভাবলাম ঢাকামুখী একটি পরিবার তো আমি থামাতে পারি। ওর স্বামীকে একটা রিক্সা কিনে দেওয়া হলো। ও ফিরে এলো কুড়িগ্রাম।

ঢাকার পরিবেশ রক্ষায় সবুজ ঢাকার আন্দোলন জোরদার করতে হবে। সরকারী প্রচারনার পাশাপাশি জনগনকে সচেতন হতে হবে অবশ্যই। প্রতিটি বাড়ির ছাদে বাগান করা যেতে পারে।
12442774_788339391271141_245602522_n

বহুতল ভবন এর ডিজাইন এমন হলে তো সোনায় সোহাগা 🙂  এই ভবনটি ঢাকারই একটি সবুজ ভবন (গ্রিন বিল্ডিং)
12380418_788339417937805_681715742_n

আমার পরিকল্পনা হয়ে গেলো কিছুটা তুঘলকি কাণ্ডের মতো। মুহাম্মদ বিন তুঘলক প্রথমে কাগজের টাকার প্রচলন করেছিলো। লোকে তাকে পাগলের প্রলাপ ও কর্মকাণ্ড বলে তিরস্কার করেছিলো। একসময় তিনি তা বন্ধ করতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে সে কাগজের টাকাই মানুষ ব্যবহার করছে, উনি মারা যাবার অনেক বছর পরে।

যাই হোক আমি ধারাবাহিক তুঘলকি চিন্তা করতে থাকি। আর লিখে সোনেলার মাথা নষ্ট করি।

0 Shares

২৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ