রিহানের সবে দুধদাঁত পড়তে শুরু করেছে।
এক চমৎকার সূর্য উঠি উঠি সকালে স্কুলে যাবার পথে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিস্ময় নিয়ে বলে, "আম্মু, লুক লুক, মুন !" আমি সেদিকে তাকাই। গাঢ় নীল আসমানে আধখানা ফ্যাকাসে চাঁদ। একদিকে সূর্য উঠছে, অন্যদিকে জলছবির মতো ঘোলাটে হয়ে আসা চাঁদ। চাঁদ তো রাতের অন্ধকারে থাকবার কথা ! দিনের আলো ফোঁটার পরও আকাশে চাঁদ দেখে একটু অবাকই হয় সে। আর আমি পাহাড়সম বিস্ময় নিয়ে দেখি রিহানকে। ভাবি, এতটুকুন মানুষ এও খেয়াল করেছে ! নিশ্চয়ই একদিন সে কবি, সাহিত্যিক হবে !
স্কুলে যাবার পথটুকুতে গুনগুণ করে গান করে রিহান। গানের কথা বুঝা না গেলেও সুরটা বেশ লাগে। চুপচাপ হেঁটে যাই। মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে থাকি অনেকক্ষণ। দুপুরে বাড়ি ফিরে খাবারের সময়টাতে অসাবধানে মেঝেতে সামান্য পানি ফেলে সে। অপরাধীর মতো অসহায় দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকায়। ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে টিস্যু এনে নিজেই মুছতে থাকে। তা-ই দেখে আমি আবেগপ্রবন হয়ে উঠি। আম্মাকে দেখাই। আম্মা অস্ফুটে বলে উঠেন, মাশআল্লাহ্ ! পড়া শেষে বইগুলো ব্যাগে রাখে যখন, আমি মুগ্ধ থেকে মুগ্ধতর হই। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে তুলে আনা দাঁত বালিশের নিচে রাখে। বলে, " টুথ ফেইরি এসে এটি নিয়ে যাবে, বিনিময়ে মানি রেখে যাবে "। অতঃপর রিহান ঘুমিয়ে গেলে আমি তাঁর গায়ে গা ঘেঁষে শুয়ে থাকি। প্রচ্ছন্ন এক ভালোলাগায় ছেয়ে থাকে আমার মা-মন।
আমার চাকুরীজীবী মা'কে টুকটাক কাজে সাহায্য করার জন্যে আলমগীরকে যখন গ্রাম থেকে আনা হয়, তখন সে ঠিক এতটুকুন ছিল। রিহানের মতো। বয়স সাত পেরোয়নি। আরবী শিক্ষার জন্যে তাঁকে মসজিদে ভর্তি করানো হয়। লেখাপড়া শিখবার জন্যে স্কুলে ভর্তি করানো হয়। এরই মাঝে আম্মাকে একাজে ওকাজে সাহায্য করে। আমার এখনো মনে আছে, ডায়নিং টেবিল মুছতে হলে আলমগীর টেবিলের উপর উঠে বসতো। তারপর ঘর মোছার মতো করে মুছতো। ছোট মানুষ ! তাঁর হাত তো আর টেবিল মোছার মতো বড় হয়নি ! দুপুরে খেতে বসে কখনো কখনো বলে উঠতো, " খালুজি, ইট্টু নুন দেন "। আব্বা মিটিমিটি হাসতো, টেবিল থেকে নুন এগিয়ে দিতো।
এক জ্যোৎস্না থৈথৈ রাতে ছাদে হাঁটবার সময়টাতে আলমগীর বলে, " ছোট্ট আফা, আইজ পূর্ণিমা "। আমি বলি, তুই ক্যামনে বুঝলি ? আলমগীর বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে আকাশের দিকে দেখিয়ে বলে, " দেহেন না চান ডা থালের (প্লেট) লাহান গোল ! " দুপুরে খাবার শেষে থালা, প্লেট ধোওয়ার সময় গুনগুণ করে গান গাইতো সে। হাড়ি-পাতিলের টুংটাং শব্দের সাথে সেইসব সুর আরও করুন, কান্না-কান্না, বিষাদময় শুনাতো। বেশ ক'মাস বাদে এক নিস্তব্দ শীতের বিকেলে আলমগীরের প্রথম দুধদাঁত পড়তে শুরু করে। সে দাঁতটি কাগজে মুড়িয়ে রাখলো। ইঁদুরের গর্ত খুঁজে বেড়ালো। একদিন বলে, " ছোট্ট আফা, ইন্দুরের গর্তে ফালাইলে ইন্দুরের লাহান চিকন দাঁত উঠবো !" অতঃপর রাতে শীতল পাকা মেঝেতে ঘুমিয়ে যেতো। কতদিন বলেছি, "এতো বড় বিছানা, তুই খাটে মশারীর নিচে এসে ঘুমা। কিন্তু মশারীবিহীন, শক্ত মেঝেতেই প্রশান্তির ঘুম তাঁর !
আলমগীরদের চাঁদ দেখানোয় আমরা মুগ্ধ হই না, গুনগুণিয়ে গান গাওয়ায় মুগ্ধ হই না। দু'বেলা ভালো-মন্দ পেট পুরে খেয়ে বেঁচে থাকার নামই যেখানে জীবন, সেখানে ঘুমন্ত আলমগীরদের গায়ে গা ঘেঁষে প্রচ্ছন্ন এক মায়ায় ছেয়ে থাকা মায়ের মন যে বড় বেশি বিলাসিতা ! কি অদ্ভুত বৈপরীত্য !
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
১৩টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
সৃতি, পরিবেশ প্রকৃতি অতীত জানান দেই আমাদের মাঝে বিভেদ আছে , ছিল। থাকবে।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। এইসব বিভেদ না থাকলে বেশ হতো।
জিসান শা ইকরাম
দু অবস্থানে থাকা দুটি শিশুর অবস্থার কথা বলেছেন,
দেখা এবং অনুভবের শক্তি আপনার বরাবরই প্রবল,
আপনার এই গুণই মুগ্ধতা রেখে যায়।
শুভ কামনা।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, দাদাভাই। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু আমাদের দেশে কাজের মানুষকে কেইবা আপন করে নেয় বলো?
আর যারা নেয়, তাদের দেখে চোখ ট্যাটায় অন্যেরা।
আমার ছেলেটার জন্মের পর দশ বছরের একটা পিচ্চি মেয়ে লক্ষ্মী এসে থাকতো। বড়ো মিষ্টি, আর তেমনই দুষ্টু। আদুরে মেয়েটা, কিন্তু ও কি আর আমার ছেলের মতো আদর পেয়েছে? নাকি পেরেছি দিতে? সন্তানের সাথে কারুরই তুলনা নেই।
তোমার লেখার ধরণই অন্যরকম। তাইতো ভালো লাগে।
ভালো থেকো। -{@
রিমি রুম্মান
আমাদের আলমগীরও অনেক দুষ্ট ছিল। স্কুলে অন্য বাচ্চাদের সাথে মারামারি লেগে থাকতো। বেঞ্চি উল্টে রাখতো। তাঁকে নিয়ে স্যারদের অভিযোগের অন্ত ছিল না।
নীলাঞ্জনা নীলা
হাহাহাহাহাহাহা।
বেশ মজা তো! 🙂
নিহারীকা জান্নাত
মুগ্ধ হলাম। এভাবে ক’জন ভাবতে পারে?
ভালো থাকুন আপা।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন আপনিও।
আপনাকে সোনেলায় দেখে ভালো লাগছে। -{@
নিহারীকা জান্নাত
আপা, সোনেলার একদম শুরুতে ছিলাম। তারপর পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। এখন সুস্থ্য হয়ে আবার ফেরৎ এসেছি 🙂
ইঞ্জা
খুব সুন্দর করে মনের কথা গুলো বললেন আপু, ছেলেদের জন্য দোয়া রইল।
রিমি রুম্মান
আপনার পরিবারের জন্যেও দোয়া রইলো।
ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন।
ইঞ্জা
শুভকামনা