আমাদের মুগ্ধতা !

রিমি রুম্মান ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, বুধবার, ১২:০৯:০৯অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১৩ মন্তব্য

রিহানের সবে দুধদাঁত পড়তে শুরু করেছে।

এক চমৎকার সূর্য উঠি উঠি সকালে স্কুলে যাবার পথে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিস্ময় নিয়ে বলে, "আম্মু, লুক লুক, মুন !" আমি সেদিকে তাকাই। গাঢ় নীল আসমানে আধখানা ফ্যাকাসে চাঁদ। একদিকে সূর্য উঠছে, অন্যদিকে জলছবির মতো ঘোলাটে হয়ে আসা চাঁদ। চাঁদ তো রাতের অন্ধকারে থাকবার কথা !  দিনের আলো ফোঁটার পরও আকাশে চাঁদ দেখে একটু অবাকই হয় সে। আর আমি পাহাড়সম বিস্ময় নিয়ে দেখি রিহানকে। ভাবি, এতটুকুন মানুষ এও খেয়াল করেছে ! নিশ্চয়ই একদিন সে কবি, সাহিত্যিক হবে !

স্কুলে যাবার পথটুকুতে গুনগুণ করে গান করে রিহান। গানের কথা বুঝা না গেলেও সুরটা বেশ লাগে। চুপচাপ হেঁটে যাই। মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে থাকি অনেকক্ষণ। দুপুরে বাড়ি ফিরে খাবারের সময়টাতে অসাবধানে মেঝেতে সামান্য পানি ফেলে সে। অপরাধীর মতো অসহায় দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকায়। ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে টিস্যু এনে নিজেই মুছতে থাকে। তা-ই দেখে আমি আবেগপ্রবন হয়ে উঠি। আম্মাকে দেখাই। আম্মা অস্ফুটে বলে উঠেন, মাশআল্লাহ্‌ ! পড়া শেষে বইগুলো ব্যাগে রাখে যখন, আমি মুগ্ধ থেকে মুগ্ধতর হই। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে তুলে আনা দাঁত বালিশের নিচে রাখে। বলে, " টুথ ফেইরি এসে এটি নিয়ে যাবে, বিনিময়ে মানি রেখে যাবে "। অতঃপর রিহান ঘুমিয়ে গেলে আমি তাঁর গায়ে গা ঘেঁষে শুয়ে থাকি। প্রচ্ছন্ন এক ভালোলাগায় ছেয়ে থাকে আমার মা-মন।

আমার চাকুরীজীবী মা'কে টুকটাক কাজে সাহায্য করার জন্যে আলমগীরকে যখন গ্রাম থেকে আনা হয়, তখন সে ঠিক এতটুকুন ছিল। রিহানের মতো। বয়স সাত পেরোয়নি। আরবী শিক্ষার জন্যে তাঁকে মসজিদে ভর্তি করানো হয়। লেখাপড়া শিখবার জন্যে স্কুলে ভর্তি করানো হয়। এরই মাঝে আম্মাকে একাজে ওকাজে সাহায্য করে। আমার এখনো মনে আছে, ডায়নিং টেবিল মুছতে হলে আলমগীর টেবিলের উপর উঠে বসতো। তারপর ঘর মোছার মতো করে মুছতো। ছোট মানুষ ! তাঁর হাত তো আর টেবিল মোছার মতো বড় হয়নি ! দুপুরে খেতে বসে কখনো কখনো বলে উঠতো, " খালুজি, ইট্‌টু নুন দেন "। আব্বা মিটিমিটি হাসতো, টেবিল থেকে নুন এগিয়ে দিতো।

এক জ্যোৎস্না থৈথৈ রাতে ছাদে হাঁটবার সময়টাতে আলমগীর বলে, " ছোট্ট আফা, আইজ পূর্ণিমা "। আমি বলি, তুই ক্যামনে বুঝলি ? আলমগীর বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে আকাশের দিকে দেখিয়ে বলে, " দেহেন না চান ডা থালের (প্লেট) লাহান গোল ! " দুপুরে খাবার শেষে থালা, প্লেট ধোওয়ার সময় গুনগুণ করে গান গাইতো সে। হাড়ি-পাতিলের টুংটাং শব্দের সাথে সেইসব সুর আরও করুন, কান্না-কান্না, বিষাদময় শুনাতো। বেশ ক'মাস বাদে এক নিস্তব্দ শীতের বিকেলে আলমগীরের প্রথম দুধদাঁত পড়তে শুরু করে। সে দাঁতটি কাগজে মুড়িয়ে রাখলো। ইঁদুরের গর্ত খুঁজে বেড়ালো। একদিন বলে, " ছোট্ট আফা, ইন্দুরের গর্তে ফালাইলে ইন্দুরের লাহান চিকন দাঁত উঠবো !" অতঃপর রাতে শীতল পাকা মেঝেতে ঘুমিয়ে যেতো। কতদিন বলেছি, "এতো বড় বিছানা, তুই খাটে মশারীর নিচে এসে ঘুমা। কিন্তু মশারীবিহীন, শক্ত মেঝেতেই প্রশান্তির ঘুম তাঁর !

আলমগীরদের চাঁদ দেখানোয় আমরা মুগ্ধ হই না, গুনগুণিয়ে গান গাওয়ায় মুগ্ধ হই না। দু'বেলা ভালো-মন্দ পেট পুরে খেয়ে বেঁচে থাকার নামই যেখানে জীবন, সেখানে ঘুমন্ত আলমগীরদের গায়ে গা ঘেঁষে প্রচ্ছন্ন এক মায়ায় ছেয়ে থাকা মায়ের মন যে বড় বেশি বিলাসিতা ! কি অদ্ভুত বৈপরীত্য !

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

 

0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ