আজ জন্মদিন আমার

রিমি রুম্মান ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১১:৩৮:৫৫পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২৭ মন্তব্য

সময়টা ২০০৩। জুন মাসের চমৎকার একটি দিন।

আমার প্রথম সন্তান রিয়াসাত জন্মালো। তাঁর জন্মের একমাস আগ অবধি আমি জব করি। জবটি জরুরি ছিল। শরীরের ভেতর আরেকটি শরীর বহন করে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু খেয়ে রওয়ানা দিতাম কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। এরপর পথিমধ্যে বমি করতে করতে যাওয়া। ট্রেনে উঠে মনে মনে দোয়া করতে থাকি, আজ যেন রুজভেল্ট এভিনিউর এস্কেলেটরটা সচল থাকে। বলা বাহুল্য, ওই সময় প্রায় প্রতিদিনই সেটি মেরামতের কাজ চলতো। কাজ থেকে ফেরার পথে পথিমধ্যে ট্রেন বদল করতে হতো। গ্রাউণ্ড ফ্লোর থেকে অনেক উপরে ৭ নং ট্রেন। কয়েক সিঁড়ি উঠি। দাঁড়িয়ে থাকি। শ্বাস নেই। আবার খানিক উঠি। উপরে উঠার সিঁড়ি যে আর শেষ হয় না ! একদিন গুনে দেখি সবমিলে ৯৭ টি স্টেপ ! এভাবেই দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরতাম প্রতি রাতে। দশ মাস পর সন্তান জন্মদানের সময়কার কষ্টের কথা আর না-ই বলি। শুধু বলি, পৃথিবীর কোন কষ্টের সাথেই একজন মা'য়ের সন্তান জন্মদানের কষ্টের তুলনা হতে পারে না। ভয়াবহ এক অন্ধকার। সেখান থেকে কেউ ফেরে, কেউ ফেরে না ।

এ কষ্ট কেমন করে ভুলে যায় প্রতিটি মা ! কেমন করে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়জন জন্মায় ! ক'বছর বাদেই উত্তর পেয়ে যাই। মনে হতে থাকে, এত কষ্ট করে যাকে পৃথিবীর আলো-বাতাসে নিয়ে এলাম, তাঁর কোন ভাই-বোন থাকবে না, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করার কিংবা বাবা-মা'র অবর্তমানে বিপদে এগিয়ে আসার কেউ থাকবে না, এ কেমন করে হয়। এরপর আবারও সেই কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। তখন ২০১০। এবার ভয়াবহ আরেক অভিজ্ঞতা। পুরো দশমাসই যমের সাথে লড়াই চলে। যম নিয়ে যেতে চায়। আমি বেঁচে থাকতে চাই আমার ছয় বছরের ছেলেটির জন্যে। আটমাস লড়াই করে করে ক্লান্ত আমি জ্বরে পুড়ে যেতে থাকি। ডাক্তার চিন্তিত হয়ে উঠে। হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে পাঠানো হয় ইন্‌টেনসিভ কেয়ারে। মুখে অক্সিজেন,হাতে পা'য়ে, আঙুলে, সমস্ত শরীরে নানান রকম যন্ত্রপাতির তার আর নলে জড়িয়ে পেঁচিয়ে রাখা হয় আমায়। এক একটি মেশিন শরীরের এক একটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা জানান দেয়। স্যালাইন দেয়া, ব্লাড নেয়া সহ প্রতিদিন অগনিতবার সুঁই এর আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হই। ডাক্তার, নার্স, সবাই মাস্ক মুখে দিয়ে রুমে ঢুকে। আমি কারো মুখের অভিব্যক্তি দেখতে পাইনা। শুধু কুচ্‌কে থাকা কপালটুকু দেখে আন্দাজ করি, আমি সম্ভবত মারা যাচ্ছি। বাবা-মা'কে খুব মনে পড়ে। ভাইবোন দুটোর মুখ ভেসে উঠে। ছয় বছরের একমাত্র সন্তানকে খুব দেখতে মন চায়। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরতে মন চায়। কতদিন ছুঁয়ে দেখা হয় না ! কিন্তু ইন্‌টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে কারো ঢুকতে মানা। বিধায় ছোট্ট রিয়াসাতকে নিয়ে ওর বাবা দূরের রাস্তায় এক গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়, যেখান থেকে আমার রুমের জানালা দিয়ে আমি তাকে এক নজর দেখতে পাই। আরও ভালো করে দেখাবার জন্যে ওর বাবা ওকে কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দূরের সবকিছুই অস্পষ্ট। সেই অস্পষ্ট ছোট্ট রিয়াসাত'কে দেখে ভেতরটা হুহু করে উঠে। হাসপাতালের সাদা বালিশ অশ্রুজলে ভিজে উঠে।

 

দেশে মা রাতভর দীর্ঘ প্রার্থনায় বসে থাকে। আমার মৃত্যুপথ যাত্রী বাবা মসজিদে দোয়া পড়ায়। ফোন দিলে অস্পষ্ট স্বরে বলে, "মা'রে, তোর জন্যে মসজিদে দোয়া পড়াইসি, এতোগুলা মানুষের দোয়ায় ভালো হইয়া যাইবি "। এদিকে শারীরিক যন্ত্রণায় ধীরে ধীরে আমার জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যেতে থাকে। জীবনকে বিষাক্ত মনে হয়। মনে হতে থাকে, যত তাড়াতাড়ি মৃত্যু, ততো তাড়াতাড়ি মুক্তি। অজ্ঞাত সেই ফ্লু এর কারনে যখন সারা বিশ্বেই শতশত মানুষ মারা যাচ্ছিল, তখন আমি সবার দোয়া, ডাক্তারদের নিবিড় চিকিৎসা আর সৃষ্টিকর্তার কৃপায় বেঁচে উঠি।

হাসপাতাল থেকে যেদিন রিলিজ পাই, সেইদিন যেন বহু বহু যুগ পরে বাইরের মুক্ত আলো-বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেই। পৃথিবীটাকে আগের চাইতে আরো সুন্দর,ঝলমলে মনে হতে থাকে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে আসে। অতঃপর জুলাইয়ের এক রৌদ্রজ্জ্বল দিনে দ্বিতীয়জনের জন্ম হয়। তাঁর নাম রিহান।

প্রতিটি মা'য়েরই সন্তান জন্মদানের দুঃসহ কিছু গল্প থাকে। গল্পগুলোর মাঝে ভিন্নতা থাকে হয়তো। তবে অসহনীয় কষ্টগুলোতে ভিন্নতা নেই। আমার, আপনার, আমাদের সকলের মা'য়েরা এমন কষ্ট করেই আমাদের পৃথিবীতে এনেছেন নিশ্চিত। এখন ২০১৭। আমার বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই। রাত জেগে দীর্ঘ প্রার্থনা করবার কেউ নেই। ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে কেউই বলে উঠে না, " মা'রে, তোর জন্যে মসজিদে দোয়া পড়াইসি, এতোগুলা মানুষের দোয়ায় ভালো হইয়া যাইবি "।

প্রতিবার জন্মের এইদিনে মা'কে, বাবাকে খুব মনে পড়ে।

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 Shares

২৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ