iDxJmGLYdGEv

শেখ কুদরতউল্লাহ ও একরামউল্লাহ শেখের মৃত্যুর দুই এক পুরুষ পর থেকেই শেখ বাড়ির পতন শুরু হয়। পরপর কয়েকটা ঘটনার পরেই শেখদের আভিজাত্যটাই থাকল, অর্থ ও সম্পদ শেষ হয়ে গেল।

ইংরেজরা মুসলমানদের ভাল চোখে দেখত না। প্রথম ঘটনা, রাণী রাসমনি হঠাৎ জমিদার হয়ে শেখদের সাথে লড়তে শুরু করলেন, ইংরেজও তাঁকে সাহায্য করল। কলকাতার একটা সম্পত্তি ও উল্টোডাঙ্গার আড়ত শেখদের সম্পত্তি ছিল। এই সম্পত্তি দেখাশুনা করতেন শেখ অছিমুদ্দিন। আবার জমিদারি নিয়েও রাসমনির স্টেটের সাথে দাঙ্গাহাঙ্গামা লেগেই ছিল। শেখ বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে শ্রীরামকান্দি গ্রামে তজিমুদ্দিন নামে এক দুর্ধর্ষ লোক বাস করত। সে রাসমনি স্টেটের পক্ষ অবলম্বন করেছিল। সে ভাল যোদ্ধা ছিল। একবার দুই পক্ষে খুব মারামারি হয়। এতে রাণী রাসমনির লোক পরাজিত হয়। শেখদের লোকেদের হাতে তমিজুদ্দিন আহত অবস্থায় ধরা পড়ে এবং শোনা যায় যে, পরে মৃত্যুবরণ করে। মামলা শুরু হয়। শেখদের সকলেই গ্রেফতার হয়ে যায়। পরে বহু অর্থ খরচ করে হাইকোর্ট থেকে মুক্তি পায়।

এরপরই আর একটা ঘটনা হয়। টুঙ্গিপাড়া শেখ বাড়ির পাশেই আরেকটা পুরানা বংশ আছে, যারা কাজী বংশ নামে পরিচিত। এদের সাথে শেখদের আত্মীয়তাও আছে। আত্মীয়তা থাকলেও রেষারেষি কোনদিন যায় নাই। কাজীরা অর্থ-সম্পদ ও শক্তিতে শেখদের সাথে টিকতে পারে নাই, কিন্তু লড়ে গেছে বহুকাল। যে কাজীদের সাথে আমাদের আত্মীয়তা ও ঘনিষ্টতা ছিল তারা শেখদের সমর্থন করত। কাজীদের আর একটা দল রাণী রাসমণির সাথে যোগদান করে। তারা কিছুতেই শেখদের আধিপত্য সহ্য করতে পারছিল না। তাই তারা এক জঘন্য কাজের আশ্রয় নিল শেষ পর্যন্ত। অধিকাংশ কাজী শেখদের সাথে মিশে গিয়েছিল। একটা দল কিছুতেই শেখদের শেষ না করে ছাড়বে না ঠিক করেছিল। বৃদ্ধ এক কাজী, নাম সেরাজতুল্লা কাজী। তার তিন ছেলে ও এক মেয়ে ছিল। ছেলেরা এক ষড়যন্ত্র করে এবং অর্থের লোভে বৃদ্ধ পিতাকে গলা টিপে হত্যা করে শেখ বাড়ির গরুর ঘরের চালের উপরে রেখে যায়। এই ঘটনা শুধু তিন ভাই এবং তাদের বোনটা জানত। বোনকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছিল। শেখ বাড়িতে লাশ রেখে রাতারাতিই থানায় যেয়ে খবর দেয় এবং পুলিশ সাথে নিয়ে এসে লাশ বের করে দেয় এবং বাড়ির সকলকে গ্রেফতার করিয়ে দেয়। এতে শেখদের ভীষণ অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়।

আমার দাদার চাচা এবং রেণুর দাদার বাবা কলকাতা থেকে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষনা করে চলে আসেন বাড়িতে। কলকাতার সম্পত্তি শেষ হয়ে যায়। তারপর যখন সকলে গ্রেফতার হয়ে গেছে, কেউই দেখার নাই-বড় বড় ব্যবসায়ী, মাঝি ও ব্যাপারীরা নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে উধাও হতে শুরু করল। এর পূর্বে তমিজুদ্দিনের খুনে যথেষ্ট টাকা খরচ হয়ে গেছে। জমিদারিও নিলাম হয়ে প্রায় সবই চলে যেতে লাগল। বহুদিন পর্যন্ত মামলা চলল। নিচের কোর্টে সকলেরই জেল হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত কলকাতার হাইকোর্টে মামলা শুরু হল। আমাদের এডভোকেট হাইকোর্টে দরখাস্ত করল সিআইডি দ্বারা মামলা আবার ইনকোয়ারি করতে। কারণ এ মামলা ষড়যন্ত্রমূলক। হাইকোর্ট মামলা দেখে সন্দেহ হলে আবার ইনকোয়ারি শুরু হল। একজন অফিসার পাগল সেজে আমাদের গ্রামে যায় আর খোঁজ খবর নেয়। একদিন রাতে সেরাজতুল্লাহ কাজীর তিন ছেলের মধ্যে কি নিয়ে ঝগড়া হয় এবং কথায় কথায় এক ভাই অন্য ভাইকে বলে “বলেছিলাম না শেখদের কিছু হবে না, বাবাকে অমনভাবে মারা উচিত হবে না।” অন্য ভাই বলে, “তুই তো গলা টিপে ধরেছিলি তাই তো বাবা মারা গেল।” বোনটা বলল, “বাবা একটু পানি চেয়েছিল, তুই তো তাও দিতে দিলি না।” সিআইডি এই কথা শুনতে পেল ওদের বাড়ির পিছনে পালিয়ে থেকে। তার কয়েকদিন পরেই তিন ভাই ও বোন গ্রেফতার হল এবং স্বীকার করতে বাধ্য হল তারাই তাদের বাবাকে হত্যা করেছে।

অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান।(পৃষ্ঠা নং-০৫ ও ০৬)

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পর্ব- ২

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ