মানবিক ও বাস্তবতার বেড়াজাল

রিতু জাহান ১২ অক্টোবর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ০১:১৯:৩৭অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি, সমসাময়িক ৮ মন্তব্য

রোহিঙ্গা নিয়ে কিছু লিখব না ভেবেছিলাম। গতবছর আমিই বলেছিলাম, কিছু মানুষ আশ্রয় দিলে এ আর এমন কি হবে! ফেসবুকে তাদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে অন্যের বিরুপ মনোভাবে বিরক্তও যে হইনি তা নয়, হয়েছি। আসলে আমরা অনেক বেশি মানবিক বলেই, হঠাৎ করে এসব ঘটনার কঠিন বাস্তবতা ভুলে যাই। হিসেব করি না, সামনে কি হবে। আমি মানবিক বা অমানবিক কিনা জানি না। আমি শুধু জানি বৈশিষ্ট মতে আমি একজন স্বাভাবিক মানুষ।

ছোটবেলায় শুনেছি ও পড়েছি, সবার আগে দেশ। দেশ মানে মা। আমি আমার দেশের একজন সাধারন নাগরিক। আমি আমার দেশকে ভালবাসি। আমি আমার দেশকে নিয়ে অহংকার করি। এই দেশকে নিয়ে বিশ্বের দরবারে অহংকার করার মতো অনেক কিছুই আমার আছে। আমার আছে নিজের মায়ের ভাষা রক্ষা করে টিকে থাকার গৌরব, আমার আছে নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জয় করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার গৌরব। হাজার পর্যটক শাসকদের শত শত বছরের শাষণের পরেও আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ধরে রাখার গৌরব। যে যতোই বলুক দুই একটি ঘটনা ছাড়া ধর্মীয় সম্পৃতির  মিল বন্ধনেরও দেশ আমার বাংলাদেশ। আমার পূর্ব পুরুষ থেকে শুরু করে আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই দেশের মাটির মানুষ।

আমরা দেশের মানুষ এবং বিশ্বের মানুষ জানি, বাংলাদেশ নিন্ম অঞ্চল। বন্যা কবলিত একটি দেশ আমাদের। শত প্রতিকূল পরিবেশেও আমরা উন্নয়নের সিঁড়িতে উঠে চলেছি। অর্থনৈতিকভাবে খুব যে একটা বেশি শক্তিশালী আমরা তা নয়। আমরা সম্প্রতি বাল্য বিয়ে থেকেও বের হয়ে আসতে পারছি। আমরা শিক্ষা ক্ষেত্রেও কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে এসেছি। স্বাস্থ্য খাতেও তাই। মা ও শিশু মৃত্যু হার অনেক কমে গেছে। সব থেকে বড় অর্জন নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু। আমরা পারি। বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে পেরেছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে যেভাবে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কথা বলেছে, তাতে আমি বাংলাদেশি হিসেব গর্ব করি। সবাই আমাদের দেশকে মানবিক পরিচয়ে জানছে সবই ঠিক আছে।

কিন্তু এতো এতো অর্জন সব টিকে রাখতে পারব তো! আমি আগে একটা লেখায় বলেছিলাম, ' আশ্রিত যেনো না হয় শেয়াল মগজ'।  আমি পয়েন্ট আকারে যদি তাদের বৈশিষ্টগুলি বলি তহলে এমন দাঁড়ায়ঃ

১. রোহিঙ্গা শিশু জন্মহার অনেক বেশি।
২. রোহিঙ্গাদের মাঝে বাল্য বিয়ের প্রবণতা বেশি।
৩. আমরা ইতিমধ্যেই দেখলাম অনেক রোহিঙ্গা নারীদের শরীরে এইডস্ দেখা গেছে।
৪. রোহিঙ্গাদের মাঝে মাদক সেবনের প্রবণতাও বেশি।
৫. রোহিঙ্গাদের ভাষা সংস্কৃতি আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
৬. রোহিঙ্গারা উগ্র মেজাজের।

আরো অনেক অসংগতি আছে। আমি শুধু অল্প কিছই তুলে ধরলাম।

আমাদের যা ক্ষতি হবে তা হলোঃ
১. আমাদের দেশ ছোটো, সেই তুলনায় এমনিতেই আমাদের জনসংখ্যা অনেক বেশি। তার উপর বাড়তি এই তাৎক্ষণিক দশ লাখ রোহিঙ্গা। একবার ভাবুন তো, দুই একবছর পর এদের জনসংখ্যা কোথায় দাঁড়াবে! কোথায় পাবেন এতো খাবার, কোথায় পাবেন এতো আবাসস্থল। কি করবেন? ফসলি জমি কমিয়ে ফেলবেন? পাহাড় কেটে ফেলবেন? যদিও পাহাড় এখন আছেই সীমিত। আমাদের ফসলি জমির উপর প্রভাব পড়বে। আমরা হারাব বনভূমি। হারিয়েও ফেলেছি ইতিমধ্যে অনেক।
২. পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। তার আশপাশেই তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আর ব্যবস্থা করলেও কি না করলেও কি, তারা ওখান থেকে যাবেও না কোথাও। এতে করে কি হবে, আমাদের সমুদ্র সৈকত তার সৌন্দর্য হারাবে। দেশে পর্যটন ব্যবসায় ক্ষতি হবে।
৩. রোহিঙ্গারা অল্প টাকায় শ্রম দিবে। এতে করে আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষ তার ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হবে। কারণ, আমাদের দেশের কিছু মানুষ আছেই তারা সস্তায় এসব রোহিঙ্গা মানুষদের কাজে লাগাবে আর এই সস্তা খুঁজতে গিয়ে বিশৃঙ্খলতার সৃষ্টি করবে। দেশী শ্রমিকদের বেকার সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তারাও তখন বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়বে।
৪. আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি মায়ানমার থেকে প্রচুর ইয়াবা সমুদ্রপথে বাংলাদেশে ঢুকতে। কথা হচ্ছে, এখন এই সুযোগে কতোটা ঢুকছে তার কতটুকু হিসেব আমরা রাখতে পারছি বা ধরতে পারছি।                            ৫. পেটের ক্ষুধার জন্য যে কেউ যে কোনো কাজ করতে পারে। রোহিঙ্গা না্রীরা খুব অল্প টাকায়  তাদের শরীর বিক্রি করবে। অপরিকল্পিত যৌন কাজে তারা লিপ্ত হবে। আমাদের যুব সমাজ হবে এর শিকার। ভাবতে পারেন কি হবে!
৬. আমরা দেখতে পাচ্ছি ইতিমধ্যে অনেকেই রোহিঙ্গা নারীদের বিয়ে করছে। এতে আমাদের সমাজ সংস্কৃতির উপর প্রভাব পড়বে।
৭. আমরা সব সময়ই কম বেশি জঙ্গি আতঙ্কে ভুগি। জঙ্গিরা রো হিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে জঙ্গি কাজে টেনে নিবে না তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে! না নেই।
৮. স্বাস্থ্য গত দিক থেকে দূষণের কথা বলতে গেলে তা তো আরো ভয়াবহ। এতো মানুষের পয়োনিষ্কাষণের ব্যাবস্থা করা চাট্টিখানি কথা নয়। আমরা মিডিয়ার কল্যাণে দেখতে পাচ্ছি তারা যেখানে সেখানে প্রাকৃতিক কাজ সারছে। এর প্রভাব পড়ছে স্থানীয়দের উপর।
৯. অনেকেই বলতে পারেন, তারা তো আশ্রয় হিসেবে নির্দিষ্ট জায়গাতেই আছে, ভয় নেই। কিন্তু ইতিমধ্যেই আমরা দেশের বিভিন্ন জায়গাতে রোহিঙ্গাদের দেখতে পাচ্ছি। তারা ছড়িয়ে পড়েছে এবং প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়ছে। এতে করে তাদের শনাক্ত করাও মুশকিল হবে। কারণ, শরীরের গঠন অনেকটা আমাদের মতোই। এতে করে উদ্বাস্তু জনসংখ্যার সংখ্যা বেড়ে যাবে। রেল স্টেশন থেকে শুরু পথেঘাটে গৃহহীন আরো মানুষের যোগ হবে। ঢাকার ফুটপাত থেকে শুরু করে বস্তিতে আরো লোকসংখ্যা বাড়বে। যেখানে সরকারের একটা লক্ষ্য ছিলো ঢাকা মুখি লোক কমানো তা আর সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। আমরা মানবিক দিক চিন্তা করে তাদের যখন আশ্রয় দিয়েই ফেলেছি তখন উচিৎ হবে, সর্বক্ষণ তাদের নজরদারিতে রাখা। কিন্তু তা কতটুকু সম্ভব। ইতিমধ্যে দেখতে পাচ্ছি কেউ কেউ তাদের বিয়েও করছে!

মায়ানমার সরকার তাদের ফেরত নিবে আমি বিশ্বাস করি না। কারণ, তারা ফেরৎ নেবার যে শর্ত দিয়েছে তা প্রমাণ করা সহজ কথা নয়। আইডি কার্ড, কতজনের কাছে আছে, জমির কাগজ, বিয়ের কাগজ রোহিঙ্গাদের নেই। কারণ, মায়ানমার সরকারের আইনমতে তারা আগে থেকেই সে দেশের অবৈধ। রোহিঙ্গা আদিবাসি পশ্চিম মায়ানমারের আরাকান রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠী। রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প আছে। তা হলো, সপ্তম শতাব্দিতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বলে, আল্লাহর রহম বেঁচে গেছি' এই রহম থেকে এসেছে রোহিঙ্গা। ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারি মায়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে। সে সময় পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিলো। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন সরকারি পদস্থ দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাস্ট্রক্ষমতা দখল করলে মায়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে থাকে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। সকল নাগরিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত হয়। এমনকি তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকাশ করতে দেওয়া হতো না, তাদের বিয়েও বৈধ ছিলো না। তাই তাদের সে দেশে আইনত কোনো কিছুরই ডকুমেন্ট নেই। তাহলে ফল দাঁড়ালো, তারা এভাবে যত্র তত্র দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়বে। অনেকেই বলতে পারেন, এমনকি আমিই বলেছিলাম, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। আসলে এই ঘটনা আর ঐ ঘটনা আদৌ এক! তাদের ছিলো দেশ স্বাধীন করে এ দেশে ফিরে আসার আশা সেই সাথে নিশ্চয়তা যে, দেশ স্বাধীন হবেই এবং তারা আবারো তাদের ভূখন্ডে ফিরতে পারবে, কোনো বাঁধা নিষেধই ছিলো না। কিন্তু রোহিঙ্গাদের অবস্থাটা আসলে ঠিক তা নয়। তাই তাদের ফিরে যাবারও আশা নেই। তাই তারা চিরস্থায়ী এ ভূখন্ডেই থেকে যাবে। যদিও কেউ ফিরে যায় তবে তার সংখ্যা হবে, দশ লাখে এক লাখ।অর্থাৎ দশ লাখে এক লাখ ফেরত যেতে পারে।একটা শিশু যখন কোনো বিভৎসতা দেখে বড় হবে এবং যার কোনো আশ্রয় থাকবে না, সে শিশু কতোটা মানবিক গুনাবলিতে বড় হবে? আদৌ তার ভিতর মানবিক গুনাবলি থাকবে?
আমরা আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত যতগুলো ধর্ষণের ঘটনা দেখেছি তার বেশির ভাগই ঘটিয়েছে নিন্মশ্রেণির লোক। আর ভিকটিম হয়েছে বেশিরভাগই মেধাবী কোনো তরুণী অথবা কোনো শিশু। আমি বলছি না মানবিকতা ভুলে তাদের বিতাড়িত করতে হবে। এই সমস্যা আমাদের জাতীয় সমস্যা। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এর মোকাবিলা করতে হবে। তারা যেনো দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। জাতিসংঘ হলো ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সরদার। তাই জাতিসংঘ থেকে খুব একটা ভালোকিছু আমরা আশা করতে পারি না। আর তাছাড়া, কথায় আছে, এক মরা মানুষ কয়দিনই বা কাঁদে! তাই এই যে যৎসামান্য সাহায্য আসছে তা কতোদিন আসবে? এরপর কি হবে? আমি রাজনীতি বুঝি না। বুঝি এ দেশ আমার। এর শান্তি শৃঙ্খল নষ্ট হলে বিচলিত আমি হবোই। তাই মানবিক ও বাস্তবতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলতে চাই, আমরা চাই সুষ্ঠু সমাধান। আশ্রিত যেনো না হয় শেয়াল মগজ।

মৌনতা রিতু।
১২/১০/১৭.

0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ