পাপ স্বীকার।

রিতু জাহান ২১ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ১০:৫০:৩৩পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১৫ মন্তব্য

আমি মিশন স্কুলে পড়াশুনা করেছি। আমাদের স্কুলে চমৎকার একটি গির্জা আছে। রবিবার ছিলো প্রার্থনার দিন। তাই সকালে প্রার্থনার জন্য আমাদের রবিবার দিন সকাল সাড়ে ন'টায় ক্লাস শুরু হতো। আমরা সব ধর্মের ছেলেমেয়েরা ইচ্ছে করলে গির্জায় যেতে পারতাম। কোনো বাঁধা ছিলো না। আমি প্রায়ই যেতাম। কেমন যেনো একটা শান্তি। চুপ করে ফাদারের কথা শুনতাম। যেহেতু আমি প্রচন্ড দুষ্টু ছিলাম, ওভাবে চুপ করে বসে থাকা আমার চরিত্রের বাইরে ছিলো, তবু বসে থাকতাম। খুব ভালো লাগতো। আমাদের ফাদার ছিলেন ' ফাদার মারিনো রিগান।' ফাদার এখন ইটালি থাকেন। আমাদের স্কুল অনেক বড় স্কুল। গির্জায় একটা সিস্টেম ছিলো পাপ স্বীকার করা। একটা যায়গায় ফাদার বসে থাকবে যে পাপ স্বীকার করবে সেও আড়াল থাকবে। কেউ কারো মুখ দেখতে পারবে না। এতে করে কে পাপ স্বীকার করছে বোঝার উপায় নেই, তাই লজ্জা পাবার ও ভয় পাবার কিছু নেই। আমার অনেক বান্ধবী ছিলো। একজন ছিলো 'এ্যানি।' ওর বাড়ি ছিলো মেহেরপুরে। ওদের থাকার জন্য হোস্টেলের ব্যাবস্থা ছিলো। এ্যানির ইচ্ছে ছিলো ও মিশন স্কুলের সিস্টার হবে। হয়েছে কিনা জানি না। আমাদের একটা সিস্টার ছিলো, সিস্টার আগাথা। আমি আমরা প্রচন্ড ভয় করতাম সিস্টারকে। যাকে বলে তার সামনে স্পিক্টি নট। সিস্টার যদি একবার কাউকে সিস্টার রুমে ডেকেছে তার কান দিয়ে ধোয়া উড়বে নির্ঘাৎ। আমিও গেছি দুই, একবার। যাইহোক,আমি এ্যানিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম পাপ স্বীকার সম্পর্কে। ও বলল, এতে মনটা হালকা হয়। ভালো ভালো কথা শোনা যায় ফাদারের কাছ থেকে। ভালো দিক নির্দেশনা পাওয়া যায়। আমরা যারা মিশন স্কুলে পড়েছি, আমি দেখেছি আমাদের মধ্যে এই ধর্মীয় ভেদাভেদটা নেই। আমি বাবার চাকরি সূত্রে হসপিটাল কোয়ার্টারে বড় হয়েছি। তাই নানা মানুষের মাঝেই আমার বেড়ে ওঠা। নানারকম অভিজ্ঞতা। আমরা যে যেখানেই বসবাস করি না কেনো, ভালোমন্দ মিলিয়েই আমরা সবার সাথে বসবাস করি। আমার দুষ্টমি ও জেদের কথা স্কুল এবং কোয়ার্টার ক্যাম্পাসে সবার জানা। সত্যি বলতে দুই একজন ছাড়া আমি প্রচুর আদর ভালবাসা পেয়েছি সবার কাছ থেকে। আমাদের অফিসিয়াল পদমর্যাদা হিসেবে কোয়ার্টার ভাগ করা ছিলো। প্রথমে ছিলো টি এইচ এ কাকুর তারপর আর এম ও কাকুর তারপর অন্যান্য ডাক্তার। দ্বিতীয় সারিতে আমাদের। তারপর তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেনির কোয়ার্টার। আমাদের ঠিক সামনে ছিলো ব্যাচেলর ডাক্তার কাকুদের কোয়ার্টার। আমাকে সব আন্টিরা খুবই আদর করতো। কিন্তু একজন ছিলো সে সহ্যই করতে পারতো না। কেমন যেনো হিংসে করতো। সেই আন্টিরও ছিলো তিনটা মেয়ে। বজ্জাৎ এর হাড্ডি। সবার সাথে কম বেশি ঝগড়া করতো। বিশেষ করে নার্স আন্টিদের সাথে। ছাদে কাপড় দিলে নাই করে দিতো। আমাদের হসপিটালের বেশিরভাগ কাকুরা ছিলো ধর্ম অনুসারে হিন্দু ধর্মালম্বি। আমার ছিলো সব যায়গাতেই অবাধ যাতায়াত। বরেন কাকুর ধরতে গেলে আর একটা মেয়ে ছিলাম আমি। আন্টিদের একদমই ধর্মের ব্যাপারে নাক সিটকানো ভাব ছিলো না। কিন্তু এই ঝগড়ি তিন মা মেয়ের ছিলো। স্যারি শব্দ দূষণ করার জন্য। আমার সব থেকে ছোটো বোনটা সবার বাসায় খেয়ে বেড়াতো। ওর বিরাট এক গ্রুপ ছিলো।যাকে বলে বাচ্চা পার্টি। এই গ্রুপের কে কার বাসায় খাচ্ছে তার হিসেব নেই। স্কুলে কেবল ভর্তি হয়েছে। তার ভাবই আলাদা। একদিন এগুলো খেলতে খেলতে ঝগড়ি তিনমেয়েদের ছাদে গেছে। ওরা সেদিন কচ্ছপ রান্না করেছে। আমার ছোটো বোনসহ সবগুলোকে খাইয়ে দিছে। খাওয়ানোর পরে বলছে," তোদের কচ্ছপ খাইয়ে দিয়েছি।" এখানে কেউ কেউ পারিবারিকভাবে নিরামিশভোজি, কারো ধর্মমতে কচ্ছপ খাওয়া হারাম। সবগুলো এসে বমি করতে শুরু করেছে। ভয়ে কেউ স্বীকার করছে না। আমার সাথে এগুলোর খুব ভালো সম্পর্ক। ওদের অনেক আবদার মিটাই আমি। কারন,অফিস চলার সময় একগাদা রুগির সামনে আব্বার সহকারিকে বলতাম, "বাবুল মামা আব্বাকে বলো টাকা চাই।" আব্বাও চুপচাপ দিয়ে দিতো। সেই টাকা দিয়ে এগুলোকে খাওয়াতাম। তাই আমাকে কচ্ছপ খাওয়ানোর কথা বলে দিলো। আমার মেজাজ বিগড়ে গেলো। ওদের বললাম, কেউ যেনো কারো আম্মুকে না বলে। কারণ, আমি জানি বড়দের কানে গেলে এটা নিয়ে তুমুল কান্ড হবে। অফিস পর্যন্ত যাবে। বেচারা কাকুর উপর দিয়ে যাবে। কিন্তু আমার মনে তবু অন্য শয়তানি চাপলো। শিক্ষা দিতে হবে তিন মা মেয়েকে। তাই আমিও একদিন কায়দা করে ওদের বাড়ির ছোটো দুইটাকে মুরগির মাংসের কথা বলে খাওয়ায়ে দিলাম।(বুঝে নিয়েন)।  আমারও তখন খুব একটা বেশি বয়স না। তাই বিবেকের সাথে বোঝাপড়াটা হয়ে ওঠেনি তাৎক্ষনিক। কিন্তু পরক্ষণেই খারাপ লাগতে লাগলো। স্কুল বান্ধবী এ্যানিকে সব খুলে বললাম। এ্যানিকে বললাম, ফাদারের কাছে যাবো। ফাদারকে সব খুলে বলব। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।
আসলে খাওয়ার বিষয়ে আমাদের সবারই কিছু না কিছু রুচির ব্যাপার আছে। যেমন আমি কাঁকড়া পছন্দ করি। খুব পছন্দ করি। আমি আমার দুই ছেলেসহ খাই। আমার দুই ছেলেকে ধর্মীয় গোড়ামি ভাবটাকে ঘৃণা করতে শিখাই। বলেছি যেটা তোমার রুচি হবে না, খেও না।
আমি ঐ দুই পিচ্চি, আসলে পিচ্চিও না ওদের না বলে খাইয়েছি, অবশ্যাই ভুল করেছি। আসলে বয়সের অবশ্যাই একটা ব্যাপার থাকে। আমি আসলে তখন খুব জেদি ছিলাম। প্রতিদান দিতে পিছু হটতাম না।
আর একটা ঘটনা বলি, আমার ইমিডিয়েট বড় বোনটা ডিপথেরিয়ায় মারা যায়। আমি আর ও নাকি দেখতে হুবহু একি রকম। আমার অবশ্য ওর চেহারা মনে থাকার কথা নয়। তখন আমিই অনেক ছোটো। ও যখন মারা যায় তখন ক্লাস থ্রিতে পড়তো। আব্বা তখন চালনা হসপিটালে। আমার ধারনা ছিলো বিড়ালের লালা থেকেই একমাত্র ডিপথেরিয়া রোগটা হয়। আর তাই বিড়ালের প্রতি আমার প্রচন্ড এ্যালার্জি ঘৃণা তা যাই বলি না কেনো। আমাদের হসপিটাল কোয়ার্টারে, বিড়ালের অত্যাচার ছিলো খুব বেশি। ওরা রুগির প্লেটে মুখ দিয়ে আবার আসাদের প্লেটে মুখ দিতো। কি ভয়ংকর ব্যাপার তাই না! আমি এটা মানতে পারতাম না। বাসায় আমার একমাত্র কাজ ছিলো বিড়ালকে শাস্তি দেওয়া। আমাদের বাসায় তখন হিটারে রান্না হতো।তো একদিন শীতের মধ্যে বিড়াল দেখি খুব মজা করে হিটারের মধ্যে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে হিটারের সুইজ অন করে দিলাম। আর বিড়ালটা এমন করে আমাদের দুই তলার জানলা দিয়ে লাফ দিলো, কি বলবো! তখন তো খুব মজা পেয়েছিলাম। এখন খুব খারাপ লাগে। মনে হয় কতো নিষ্ঠুর আমি!
ছোটোবড় কতো পাপ করি আমরা। আমি এই গল্পগুলো আমার ছেলেদের দিলে ওরা হা করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আমি ওদের বলি আসলে পাপ পূণ্যের হিসেবটা বোঝানোর জন্য। আমি অনুতপ্ত এটা বুঝাই ওদের।
আজ এই বৃষ্টির মেঘলা মন খারাপের দিনে পিছনের অনেক কথা মনে পড়ছে। কিছু কথায় অস্থির হচ্ছি, কিছু কথায় চোখে পানি আসছে, কিছু কথায় হেসে উঠছি। জীবন আসলেই বিচিত্র। আমি কখনো কখনো ভাবি, আসলে সব পাপের কি ক্ষমা হয়? মনের মাঝে যা আজিবন বাসা বেঁধে থাকে তার কি ক্ষমা আছে? আমাদের হাদিস অনুসারে, যার সাথে অন্যায় করা হয় সে ক্ষমা না করলে, উপর আল্লাহ্ ও ক্ষমা করেন না। কিন্তু আমরা কি কখনো সেইসব মানুষদের কাছে গিয়ে কি বলি, তোমার সাথে আমি এটা করেছিলাম, ক্ষমা করে দিও। চট করে একটা মানুষের মনে আঘাত দিয়ে বসি। কখনো ভাবিনা তার বুকের ভিতর থেকে উঠে আসা দীর্ঘ নিঃশ্বাসে আমি ভেসে যেতে পারি। তছনছ হয়ে যেতে পারে আমার অনেক কিছু। আমিই কি পেরেছি, আমার সাথে করা অন্যের অন্যায় ক্ষমা করতে? মুখে বললেও দীর্ঘ নিঃশ্বাসের কি করবো?

জীবন তার নিয়ম মতোই চলে। জীবন সব ফিরিয়ে দেয়। জীবন ফিরাতে কার্পণ্য করে না। তা সে ভালো হোক বা মন্দ হোক। সবার মঙ্গল হোক। শুভকামনা সবার জন্য।

এটাতে ছোটো কিছু লাইন সাজাই।                    ঋতু ভালবাসার সময় জানে                              তাই তার বুকে বসন্ত সাজে, ফুল হাসে।             শরৎ সাজে নীল নীল আকাশ নিয়ে                   বুকে তার সাদা শুভ্র মেঘ ভাসে।                     জলের বুকে তার কাঁশফুলের ছায়া,                শশিরের পরশে মুক্ত বনফুল নাচে।           ভালবাসার অবজ্ঞায় আহত ঋতু,                      বুকে তার গ্রীষ্মের খরতাপ                                মাঠ ফাটে বুক ফাটে                                   কখনো মেঘ ডাকে জোরে সোরে                   গর্জায়, বরষায়।                                              বুকে তার কৃষ্ণচূড়া, হৃদয়ের অনুভূতির রক্তক্ষরণ   শিউলী ঝরে অভিমানে                                     ঝরে পড়া ঝরনার টলটলে জলের নীচে        পাথরে মুখটি তার স্পষ্ট হাসে।

,,,,,,,মৌনতা রিতু,,,,, 

২১/১০/১৭.

0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ